চন্দন বা শ্বেতচন্দন গাছ
প্রচলিত নাম : শ্বেতচন্দন
ইংরেজী নাম : Sandal Wood
বৈজ্ঞানিক নাম: Santalum album Linn.
পরিবার : Santalasceae
পরিচিতি : চন্দন ছোট থেকে মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। সাধারণতঃ ১৫-১৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ২-৪ মিটার পর্যন্ত বেড় হয়। চন্দন একটি আংশিক মূল পরজীবী উদ্ভিদ। ঘন সবুজ ছোট পাতার ডালের সাথে মুখোমুখি গজায়। গাছের ছাল গাঢ় খয়েরী এবং বড় গাছের বাকলে লম্বালম্বিভাবে ফাটল থাকে। ৪০-৬০ বছরের পরিপক্ক চন্দন গাছের সারঅংশ বাদামী এবং সুগন্ধিযুক্ত। একাধারে সুগন্ধ ও অন্যদিকে ঔষদি গুণের জন্যই চন্দনের এত কদর ও সুখ্যাতি। গাছের অসার অংশ সাদা এবং গন্ধহীন।
বিস্তৃতি : শ্বেতচন্দন ভারতের বিন্ধ্যা পর্বতের দক্ষিণে কর্ণাটক ও তামিলনাড়তে ভাল জন্মে। তবে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যাতেও চন্দন দেখা যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। ধারণা করা হয়, চন্দন ভারতীয় গাছ এবং রামায়ণ, মহাভারত এমনকি কৌটিল্লের অর্থশাস্ত্রে ও (খ্রীস্ট পূর্ব ২০০) চন্দনের উল্লেখ আছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন চন্দনের আদি নিবাস ইন্দোনেশিয়ার তিমুর দ্বীপে। শ্বেতচন্দন সমুদ্রতলের ৩৬০ মি. থেকে ১৩৫০ মি. পর্যন্ত উচ্চতায় দেখা গেলেও ৬০০ মি. থেকে ১০৫০ মি. উচ্চতার মধ্যে ভাল জন্মে। বৃষ্টিপাতও এ গাছের জন্য বিশেষ নির্ণায়ক। বার্ষিক ৬০০ মি. মি. থেকে ১৬০০ মি. মি. বৃষ্টিপাত অঞ্চলে ভাল জন্মালেও কম ঢালু বিশিষ্ট পাহাড়ী এলাকাই চন্দনের জন্য উত্তম।
বীজ সংগ্রহ সময় : জুন-সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বর-ফেব্রুয়ারী।
বীজের ওজন : প্রতি কেজিতে ৭৫০০-৮০০০
বীজ আহরণ ও চারা উত্তোলন : চন্দন গাছ বছরে দুইবার ফল দেয়। পাকা ফল দেখতে পুঁতি জামের মত ছোট ও ঘন কাল । ড্রপ ও গ্লোবুজ। প্রতি ফলে একটি বীজ থাকে, দেখতে অবিকল মটর দানার মত এবং ভাল বড় বীজ, প্রতি কেজিতে ৪৩০০ থেকে ৬০০০টি হয় এবং এর অংকুরোদগম হার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ পর্যন্ত। বীজ সাধারণত ৮-১৪ দিনে গজায়। উল্লেখ্য যে, চন্দন গাছ হট অবস্থায় বীজ দেওয়া শুরু করলেও ২০ বছর বা তার অধিক গাছের বীজই চারা উত্তোলনের জন্য উত্তম । আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত অপরিপক্ক গাছ থেকে যে বীজ পাওয়া যায় তা ছোট (প্রতি কেজিতে ৭৫০০-৮০০০) এবং অংকুরোদগমের হার শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত হয় ও ২০২৫ দিনে গজায়। সাকার এবং কপিচের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি হলেও বীজ থেকে চারা তৈরীই উত্তম পন্থা।
চন্দন গাছ বড় হয় ধীরগতিতে। তদুপরি আংশিক শেকড় পরজীবী বলে আশ্রয়ী গাছ ছাড়া আরও ধীরে বড় হয়। শ্বেতচন্দনের আশ্রয়ী গাছ হিসেবে কাল কড়ই, নিম, শিশু, সেগুন ইত্যাদি উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়। এর মাধ্যমে চন্দন গাছের শেকড় আশ্রয়ী গাছের শেকড়ে সংযোগ ঘটায় এবং খাদ্য গ্রহণ করে। চন্দন গাছ শেকড়ের সাহায্যে মাটি হতে চুন ও পটাশ সংগ্রহ করে কিন্তু নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের জন্য আশ্রয়ী গাছের শেকড়ের উপর নির্ভর করে। এ কারণে কোন পাত্রে বীজ থেকে চারা উত্তোলনের সময় বীজ বপনের আগেই পাত্রে আশ্রয়ী চারা উত্তোলন বাঞ্চনীয়।
ঔষধি ব্যবহার : প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে শ্বেতচন্দন ব্যবহার স্বর্গে আরোহণ ও পূণ্য অর্জনের উপায় হিসাবে বিবেচিত হত। প্রতিদিন নারায়ণ পূজায় শরীর চন্দনের ফোঁটায় চর্চিত করা ছিল নৈমিত্তিক প্রথা। সাম্প্রতিককালেও পূজা অর্চনা চন্দনের ফোঁটা ছাড়া শুদ্ধ হয় না। অপরপক্ষে চন্দন ছাড়া আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের কথা ভাবা যায় না।
১. আধুনিক ভেষজ শাস্ত্রে রক্তচাপ ও মাথাধরা কমাতে এবং ঘামাচি ও ব্রঙ্কাইটিস সারাতে মূলতঃ শ্বেতচন্দন ব্যবহৃত হয়। উচ্চ রক্তচাপ বা ব্রঙ্কাইটিস রোগে প্রতিদিন সকালে ৭/৮টি তুলসী পাতা খেয়ে এক ঘন্টা পর আধা কাপ দুধের সাথে এক চামচ পরিমাণ শ্বেতচন্দন ঘষা পানি খেলে ধীরে ধীরে রোগের উপশম হয়।
২. চন্দনের সাথে হলুদ বাটা ও কর্পুর কিংবা দারু হরিদ্রা মিশিয়ে শরীরে মাখলে ঘামাচি দ্রুত সেরে যায়।
৩. শ্বেতচন্দন ঘষা পানির সাথে কর্পুর মিশিয়ে মাথায় ঘষলে মাথাধরার উপশম হয়।
৪. বসন্ত রোগ হলে সাধারণতঃ রোগীর পিপাসা বেড়ে যায়। এ সময় বিশুদ্ধ পানিতে শ্বেতচন্দন ও মৌরি ভিজিয়ে রোগীকে খাওয়ালে পিপাসা লাঘব হয়।
৫. অন্য কোন ওষুধে কাজ না হলে ৩/৪ গ্রাম আমলকি এক কাপ পানিতে ভিজিয়ে রেখে দুই ঘন্টা পর হেঁকে নিয়ে সেই পানিতে আধা চামচ পরিমাণ শ্বেতচন্দন ঘষা ও একটু চিনি মিশিয়ে অল্প অল্প করে খেলে বমি বমি ভাব কেটে যায়।
৬. আবার বিশুদ্ধ পানির সাথে চাল ও চন্দন মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে মিশ্রণটি ঘেঁকে দুই ঘন্টা পরপর খেলে হিক্কা ওঠা বন্ধ হয়।
৭. প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় ঢেঁকিছাটা চাল ধুয়ে সেই পানিতে শ্বেতচন্দন ঘষে তার সঙ্গে একটু মধু মিশিয়ে খেলে প্রস্রাবের জ্বালা-যন্ত্রণা অথবা আটকে যাওয়া কিংবা রক্ত প্রস্রাবেও সুফল পাওয়া যায়।
৮. যে কোন চর্মরোগাক্রান্ত অংশে প্রতিদিন শ্বেতচন্দনের প্রলেপ মাখলে শীঘ্র উপকার পাওয়া যায় ।
সারা পৃথিবীতে চন্দন কাঠের ন্যায় চন্দন তেলেও সমধিক প্রসিদ্ধ। ১৮-২৭ কেজি চন্দন কাঠ পাউডার করে ৪৮ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে উর্ধপাতন করলে ৪৮-৭২ ঘন্টার মধ্যে চন্দন তেল জমা হবে। তবে এ সময় ১.২-২.৮ কেজি বর্গমিটার চাপ প্রয়োজন।
সাধারণ ব্যবহার : অসার কাঠ (Sapwood) জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সার কাঠ (heart wood) চন্দন কাঠ, ও সুগন্ধি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ কাঠ হিন্দুদের পূজা পার্বনে ব্যবহৃত হয়। উই বা ঘুণ পোকায় কাঠ নষ্ট হয় না। কাঠ থেকে এক প্রকার তৈল পাতন প্রক্রিয়ায় আহরিত হয় এবং ঐ তৈল পারফিউম ও কসমেটিক্স শিল্পে ব্যহহৃত হয়। এ তৈল পোকানাশক। এছাড়া ছবির ফ্রেম, আসবাবপত্র, বাক্স, চিরুনী, অলংকার ও কারুকাজের দ্রব্যে চন্দন কাঠ ব্যবহৃত হয়। চন্দন কাঠের খোদাই করা মূর্তি বা ভাস্কর্য পৃথিবীতে খ্যাতিমান।
রাসায়নিক উপদান :
সেন্টালল (Santalol), এলুহাইড্রিক্সিলিন (Allo hydroxypraline), এন্থাসায়ানিন (Anthocyaninl), ফেনল (Phenol), টেনিন (Tanin) ইত্যাদি।।