ভূমিকা: বর্তমান সময়ে জৈব কৃষি চর্চা বিশ্বব্যাপী কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার থেকে মুক্তি পেতে এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করতে অনেকেই ঝুঁকছেন প্রাকৃতিক পদ্ধতির দিকে। ড. কৃষাণ চন্দ্রের উদ্ভাবিত ওয়েস্ট ডিকম্পোজার হলো এমনই একটি জৈবিক সমাধান, যা মাটি ও ফসলের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে এবং কম খরচে উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ওয়েস্ট ডিকম্পোজার কি?
ওয়েস্ট ডিকম্পোজার Waste Decomposer হলো একটি মাইক্রোবিয়াল কালচার, যা মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থগুলিকে দ্রুত পচিয়ে ফেলে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এটি মূলত ন্যাশনাল সেন্টার অফ অর্গানিক ফার্মিং (National Centre of Organic Farming) এর ডিরেক্টর ড. কৃষাণ চন্দ্রের নেতৃত্বে তৈরি করা হয়েছে। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব, যা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ওয়েস্ট ডিকম্পোজারের উপকারিতা:
- মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি: ওয়েস্ট ডিকম্পোজার মাটির জৈবিক কার্যক্রমকে উদ্দীপিত করে, যা মাটির পুষ্টি সরবরাহ এবং উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এতে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সহজেই পাওয়া যায়, যা ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন উন্নত করতে সহায়ক।
- খরচ সাশ্রয়ী সমাধান: রাসায়নিক সারের তুলনায় এটি খুবই কম খরচে তৈরি করা যায় এবং প্রয়োগ করা যায়। ফলে এটি ছোট এবং বড় উভয় ধরনের কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী সমাধান হিসেবে কাজ করে।
- পরিবেশবান্ধব ও টেকসই: এটি সম্পূর্ণরূপে জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি, যা মাটি ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ। রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কমিয়ে এটি পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে।
- ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি: ওয়েস্ট ডিকম্পোজার ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসলের গুণগত মান উন্নত হয়। ফলে এসব ফসল বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয় এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পায়।
উপকরণ:
- গুড়: ২ কেজি
- ওয়েস্ট ডিকম্পোজার কালচার: ১ বোতল (প্রায় ৫০-১০০০ মিলি)
- পানি: ২০০ লিটার
- প্লাস্ট্রিকের ড্রাম: ২০০ লিটারের ১টি
প্রস্তুত প্রণালী:
১. প্লাস্ট্রিকের ড্রাম:
- ১টি বড় প্লাস্টিকের ড্রাম বা কন্টেইনার নির্বাচন করুন, যা প্রায় ২০০ লিটার পানি ধারণ করতে সক্ষম। পাত্রটি পরিষ্কার এবং রাসায়নিক মুক্ত হওয়া উচিত।
২. উপকরণ মিশ্রণ:
- ড্রামের মধ্যে ২০০ লিটার পানি ঢালুন।
- ২ কেজি গুড় যোগ করে মিশ্রণটি আবার ভালোভাবে নাড়ুন।
- এরপর, ওয়েস্ট ডিকম্পোজার কালচারের সম্পূর্ণ বোতলটি মিশ্রণে ঢালুন এবং ভালভাবে মিশিয়ে নিন।
৩. মিশ্রণটি ফারমেন্টেশন:
- মিশ্রণটি একটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন এবং ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত রেখে দিন। প্রতিদিন একবার মিশ্রণটি ভালোভাবে নাড়তে হবে। এভাবে ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এবং জীব ডিকম্পোজার তৈরি হয়ে যাবে।
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- প্রস্তুত হওয়া ওয়েস্ট ডিকম্পোজার মিশ্রণটি ফসলের জমিতে ১:২০ অনুপাতে পানি মিশিয়ে গাছে স্প্রে ও মাটিতে সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে।
- জমিতে প্রয়োগের জন্য, ২০০ লিটার মিশ্রণ ১ একর জমিতে প্রয়োগ করা যায়।
ওয়েস্ট ডিকম্পোজারে নিম্নোউল্লিখিত ব্যাকটেরিয়া থাকে:
- ব্যাসিলাস ফারমাস Bacillus firmus (WD1):
- ব্যাসিলাস ফারমাস Bacillus firmus উদ্ভিদের শিকড়ের বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এটি মাটির পিএইচ সমতা বজায় রেখে উদ্ভিদের পুষ্টি শোষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- ব্যাসিলাস নিয়াসিনি Bacillus niacini (WD1A):
- এই ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং মাটির জীবাণু ক্রিয়াকলাপ উন্নত করে।
- লাইসিনিবাসিলাস ফুসিফর্মিস Lysinibacillus fusiformis (WD3A):
- লাইসিনিবাসিলাস ফুসিফর্মিস Lysinibacillus fusiformis নাইট্রোজেন ফিক্সেশন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা উদ্ভিদ বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে।
- পেনিবাসিলাস ম্যাকুয়ারিয়েনসিস Paenibacillus macquariensis (WD4):
- পেনিবাসিলাস ম্যাকুয়ারিয়েনসিস Paenibacillus macquariensis মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং শিকড়ের বিকাশ ত্বরান্বিত করতে সহায়ক।
- ব্যাসিলাস সিম্প্লেক্স Bacillus simplex (WD5):
- ব্যাসিলাস সিম্প্লেক্স Bacillus simplex উদ্ভিদের পুষ্টি শোষণে সহায়ক এবং মাটির উর্বরতা উন্নত করতে কার্যকর।
- সোলিবাসিলাস সিলভেস্ট্রিস Solibacillus silvestris (WD7):
- এই ব্যাকটেরিয়া মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে সহায়ক।
- ব্যাসিলাস আমিনোভোরানস Bacillus aminovorans (WD8):
- ব্যাসিলাস আমিনোভোরানস Bacillus aminovorans মাটির পুষ্টি উপাদানগুলোকে উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য করে এবং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক।
- স্ট্রেপটোকক্কাস এসপি Streptococcus sp. (WD15):
- Streptococcus প্রজাতি মাটির জীবাণু কার্যকলাপ উন্নত করতে এবং উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম।
এই ব্যাকটেরিয়াগুলি একসঙ্গে কাজ করে মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। ওয়েস্ট ডিকম্পোজার ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের জমিতে প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মাটির উর্বরতা এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারেন।
উপসংহার:
ড. কৃষাণ চন্দ্রের ওয়েস্ট ডিকম্পোজার একটি প্রাকৃতিক এবং কার্যকরী সমাধান, যা কৃষিক্ষেত্রে জৈব পদ্ধতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী, সহজ এবং টেকসই উপায় প্রদান করছে, যা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। প্রাকৃতিক কৃষির দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে ওয়েস্ট ডিকম্পোজার হতে পারে আপনার নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।