তাল গাছ
প্রচলিত নাম : তাল
ইংরেজী নাম : Palmyra Palm
বৈজ্ঞানিক নাম : Borasus flabellifer Linn.
পরিবার : Palmae
পরিচিতি : লম্বা উঁচু পাম গাছ ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং মাথায় পাখার মত মুকুট বিস্তৃত। বাকল কালো, পাতা পাখার মতো ১২ মিটার ব্যাসার্ধের হয় এবং প্রায় ৬০-৮০ খণ্ডে বিভক্ত, মধ্যশিরা বরাবর ভাঁজ আছে। পাতার ডগা লম্বা এবং উভয় পার্শ্বে করাতের মত কালো দাঁত আছে। পুরুষ স্পেডিকস শাখাযুক্ত এবং ২০-৪০ সে. মি. লম্বা হয়। স্ত্রী স্পেডিক্সে বড় আকারের ফুল হয়। ফল ড্রোপ ও ১৫২০ সে. মি. পর্যন্ত ব্যাসার্ধের হয়।
বিস্তৃতি : তাল পমেসী পরিবারভুক্ত এক বীজপত্রী উদ্ভিদ। শাখা-প্রশাখাবিহীন, গোলাকার, সোজা ও খাড়া শক্তিশালী একটি কাণ্ডের মাথায় আছে পাখাসদৃশ শক্ত পাতার মুকুট। পাতার শিরাগুলো পত্রদণ্ডের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত বিস্তৃত। পভ্র দণ্ডের উপরের কিনারায় করাতের মত কালো রং-এর দাত আছে। তাল গাছ গুচ্ছমূলবিশিষ্ট এবং উচ্চতায় ১৮-২১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। তাল গাছ এক লিঙ্গবিশিষ্ট উদ্ভিদ অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা হয়। তাল শুধু স্ত্রী গাছেই ধরে। পরাগায়নের সুবিধার জন্য ১৫/২০ টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ থাকা প্রয়োজন। চারা লাগানোর ১০/১৫ বছর পর স্ত্রী গাছের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে মোচায় ফুল আসে। প্রতি মোচায় ১০১৫টি ফল ধরে। পরিপক্ক একটি গাছ থেকে বছরে ১৫০-২৫০ টি ফল পাওয়া যায় । ফল গোলাকার, রং কালো থেকে গাঢ় হলুদ। প্রতি ফলে ২-৩ টি বীজ থাকে। তালগাছ খুবই ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং একশত বছরের বেশি বাঁচে।
তালের চাষ নারিকেল, সুপারির মতো জনপ্রিয় না হলেও দীর্ঘকাল যাবত জমির আইলে, রাস্তার ধারে তালের চারা লাগানো যায়। তালের জন্মভুমি মধ্যআফ্রিকা। উষ্ণ মণ্ডলীয় গাছে হলেও এই গাছ শ্রীলঙ্কা, ভারত ও বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশী জন্মে। সাময়িক বন্যা ও লবনাক্ততাসহিষ্ণু এই গাছটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পাহাড়ী অঞ্চলের বিভিন্ন মাটিতে জন্মাতে পারে। অম্লভাবাপন্ন হালকা পলিমাটি তাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
বীজ সংগ্রহ : আগষ্ট – সেপ্টেম্বর
বাগান সৃজন : সরাসরি বীজ বপনের মাধ্যমে চারা উত্তোলন করা হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে (ভাদ্র-আশ্বিন) তাল পাকে। পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। একটি তাল থেকে ২-৩টি বীজ পাওয়া যায়। একটি ভাল পরিপুষ্ট বীজ ১২-১৫ সে.মি. লম্বা, ১০-১২ সে.মি. চওড়া ও ৬-৭ সে.মি. উচ্চতাসম্পন্ন হতে পারে। বীজ আবরণ খুব পুর ৪-৯ মি.মি. পর্যন্ত হতে পারে। বীজের একতলে এরাক আকৃতির ছোট একটি বৃতি আছে।
৪) বীজ সগ্রহ ও ট্রিটমেন্ট : ফালা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহিত বীজ ভালভাবে ধুয়ে ৩০ ৩০ ৩০ ফুট গভীর একটি গর্তে রাখতে হবে। ১৬ ভাগ পানির সাথে একভাগ গোবর মিশ্রিত করে সেই পানি দ্বারা বীজগুলি ভালভাবে ভিজাতে হবে । তারপর ৭(সাত)দিন ঐ বীজগুটি মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হবে। সাতদিন পর বীজ গর্ত থেকে তুলে ছায়াযুক্ত খোলা স্থানে রেখে খড়, কুটা ইত্যাদি দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখতে হবে যেন বীজগুলি বেশ উষ্ণ অবস্থায় থাকে এবং বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট না হয় । এ অবস্থায় দুই সপ্তাহ রেখে তারপর বীজগুলি বপনের জন্য বপন স্থানে নিয়ে যেতে হবে।
৫) বীজ বপন : আশ্বিন-কার্তিক মাসে ৩০ সে.মি. ৩০ সে.মি. ৩০ সে.মি. আকৃতির থালি করে প্রতি থালিতে ২টি করে বীজ ৫-৬ সে.মি. গভীর করে বপন করে ছাই মেশানো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজ বপনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বীজের এরাকের দিকটি মাটির দিকে থাকে। বীজ বপনের ৭-৮ সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কুরোদগম শুরু হয়। ভ্রণটি মাটির উপরের দিকে না এসে সরাসরি মাটির প্রায় ৩০-৪৫ সে.মি. গভীরে প্রবেশ করে। ৭-৮ সপ্তাহ পর ভ্রুণটির অগ্রভাগ বা আকৃতি ধারণ করে বাল্বের উপরি অংশ পল্লব হিসাবে মাটির উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং একইসঙ্গে একইগতিতে বাল্বের নীচের অংশ থেকেও মূল গজিয়ে মাটির আরো গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। বীজ বপনের ৭-৮ মাস পর মাটির উপরিভাগে চারার একটি পাতা দেখা যাবে। এই সময় পাতার অগ্রভাগ সূঁচালো মনে হয়। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাতাটিতে ৫টি শিরা রয়েছে এবং এই শিরার অগ্রভাগ ধারালো। চারাটি ১০-১২ সে.মি. উচ্চতা অর্জন করলে চারার গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে। বীজ বপনের ৮-১২ মাসের মধ্যে চারাটি ২০-৩০ সে.মি. উচ্চতা অর্জন করবে। এ সময় গরু-ছাগলের হাত থেকে চারাকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) পরিচর্যা: গাছের বৃদ্ধি ও ভাল ফলনের জন্য চারা রোপণের প্রথম ৫-৭ বৎসর চারা প্রতি দুচার ঝুড়ি পচা গোবর ও ছাই মিশিয়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রয়োগ করা উচিত।
সাধারণ ব্যবহার : তালগাছ গরীবের বন্ধু। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমির ক্ষয়রোধে এই গাছের জুড়ি নেই। তালগাছের প্রতিটি অংশই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগে। তাল কাঠ ঘর-বাড়ীর খুঁটি ও কাঠামো তৈরীতে এবং গুঁড়ি ডিঙ্গি নৌকা তৈরীতে গ্রাম-গঞ্জে অহরহ ব্যবহৃত হয়। তালপাতা ঘরে ছাউনি ও বেড়া তৈরীর কাজেও ব্যবহৃত হয়। পাখা, ঝাটা ও মাদুর তৈরীতে তালপাতার চাহিদা অত্যন্ত বেশী। কচি তালের কোয়া বা তালশা ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয় এবং সুস্বাদু। পাকা ফলের রস দিয়ে নানা রকম মজাদার পিঠা তৈরী হয়। তালের রস উপাদেয় পানীয় এবং গুড় ও মিছরী, ভিনেগার ইত্যাদি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। রসে চিনির পরিমাণ শতকরা ১২ ভাগ। । প্রতি বৎসর প্রতি গাছ থেকে ৪০০-৫০০ লিটার রস সংগ্রহ করা যায়। তাল গাছ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার স্বার্থে শুকনো ও আধা শুকনো পাতা কেটে ফেলতে হয়।
সাধারণ ব্যবহার : স্ত্রী গাছের কাঠ পুরুষ গাছের কাঠ অপেক্ষা ভাল। এ কাঠ খুঁটি, বীম, রোয়া, ডোঙ্গা, পানির নালা, ছাতির উঁটা, টার্নেরি ও কারুকাজে ব্যবহৃত হয়। কাণ্ডের মধ্যাংশ বা সেপ থেকে পানিয়া মদ, ভিনেগার, এরাক ও জাগেরি তৈরী হয়। পাতা থেকে পাখা, মাদুর, চাটাই, ব্যাগ, মাথার টুপি, ঝুড়ি ও পাতলা তৈরী হয়। এছাড়া, পাতা ঘরের ছাউনী ও কাগজ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। পাতার ভঁটের আঁশ খুবই মসৃণ এবং উহা রশি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। ফল সুস্বাদু এবং বীজের শাঁস খাদ্য হিসেবে তরকারীতে ব্যবহৃত হয়। তালগাছের পুস্পদণ্ড থেকে রস আহরিত হয় এবং ঐ রস থেকে তালমিশ্রি তৈরী হয়।