গাছপালা

বহেড়া গাছ

প্রচলিত নাম : বহেড়া, অক্ষ

ইংরেজী নাম : Billeric Myrobalan

বৈজ্ঞানিক নাম : Terminalia belerica Roxb.

পরিবার : Combretaceae

পরিচিতি: বৃহদাকার পত্রমোচি বক্ষ। উচ্চতায় ৪০ মিটার । পাতা একান্তর ও ডালের শীর্ষে জড়োভাবে থাকে। পাতা লম্বাটে ১৮. ২০ সে. মি.। পাতার বোটা লম্বা। বাকল নীলাভ বা ধূসর ছাই বর্ণের লম্বা, সরু ফাটলযুক্ত। ফুল সবুজাভ সাদা, ডিম্বাকৃতির ৮ সে. মি. লম্বা। শীতকালে পাতা ঝরে যায়। বসন্তকালে পাতা গজায় এবং এ সময় ফুল আসে।

বিস্তৃতি : ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার ও বাংলাদেশ বহেড়ার আদি নিবাস। বাংলাদেশের প্রায় সকল স্থানে পাওয়া যায়। দেশের মধ্যাঞ্চলের গজারী বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়।

বীজ সংগ্রহ : জানুয়ারী- ফেব্রুয়ারী।

বীজের ওজন : কেজিতে ২০০-২৫০টি।

সাধারণ ব্যবহার : কাঠ শক্ত কিন্তু ভঙ্গুর। পানিতে ভাল টেকে। কাঠ প্যাকিং বাক্স, তক্তা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়। নৌকা তৈরীতে ব্যবহার করা যায়। ফল কোষ্ট বর্ধক হিসাবে পরিচিত ঔষধ। বীজ থেকে ভাল তেল পাওয়া যায়। পাতা গবাদিপশুর খাদ্য।

বীজ বপন ও রোপন পদ্ধতি : বীজ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সংগ্রহ করা হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসে বীজ বপন করতে হয়। তবে বপন করার পূর্বে বীজকে প্রথমে ৪৮ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরবর্তীতে রৌদ্রে শুকিয়ে আবার ভিজিয়ে তা বপন করতে হয়। বীজ বপন করার পর মাটি ভেদ করে চারা গজাতে ১০-২০ দিন সময় লাগে। সাধারণতঃ জুন-জুলাই মাসে চারা রোপণ করা হয়। ৩-৪ মাস বয়সের চারা রোপণ করা যায়। তবে ২ (দুই) বছর বয়সের চারা লাগানোই উত্তম। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশে কম-বেশী বহেড়া গাছ জন্মে থাকে। ৫-৬ মিটার দূরত্বে গাছ লাগানো প্রয়োজন। চারা অবস্থায় গাছ নরম থাকে বিধায় একটি লম্বা খুঁটি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। গ্রামাঞ্চলে কিছু গাছ দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত শুস্ক জমিতে ও পাহাড়ের ঢালে বহেরার চাষ করা যায়।

সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি : বহেড়ার ফল সম্পূর্ণ রূপে পরিপুষ্ট হলে আপনা আপনি গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে যায়। ফল যাতে মাটিতে পড়ে ঘেঁতো না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে পুরো গাছে ঘন জাল দিয়ে আবৃত করে ফল সংগ্রহ করা যেতে পারে। অতঃপর ভাল করে পরিস্কার করে ধুয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হয়। শুকাবার সময় এতে যেন কোন রকম ধুলাবালি না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাছাড়া মৃদুতাপে পানিতে সামান্য উঁপিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে রৌদ্রে শুকিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। সিদ্ধ করার সময় বা রৌদ্রে শুকাবার সময় তাপমাত্রা এমন হবে যেন এর ভেষজ গুণাগুণ ঠিক থাকে। শুকানোর পর কমপক্ষে শতকরা ২ ভাগ আর্দ্রতা থাকতে হবে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বহেড়া সংরক্ষণ করা হয়। বাজারজাত করার জন্য পরিমাণ অনুযায়ী প্যাকেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্যাকেটের গায়ে সংগ্রহের উৎস এবং তারিখ থাকা বাঞ্চনীয়। সংরক্ষণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন রকম ছত্রাক, কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত না হয়।

ব্যবহার্য অংশ : ফল

ঔষধি গুণাগুণ :

বহেড়া মস্তিষ্কের শক্তিবর্ধক, পাকস্থলী বলকারক, বিবেচক, ক্ষুধাবর্ধক, হজমকারক, প্রশান্তি দায়ক, রক্তপাত বন্ধকারক, তাছাড়া অর্শ্ব, শোথ, অজীর্ণ, উদরাময়, অতিসারে বিশেষ উপকার হয়।

ঔষধি ব্যবহার :

১. আমাশয়ে : রক্ত আমাশয় কিংবা পুরাতন আমাশয়ে প্রতিবারে ৩-৪ গ্রাম বহেড়া খোসা চূর্ণ প্রত্যহ ২-৩ বার ঠাণ্ডা পানিসহ সেবন করে গেলে বিশেষ ফলপ্রদ।

২. অতিসার বা পাতলা পায়খানায় : পাতলা পায়খানায় ১ (এক) গ্রাম পরিমাণ নাগরমুথা চূর্ণ ও ৩ (তিন) গ্রাম পরিমাণ বহেড়ার খোসা চূর্ণ একত্রে দিনে ৩-৪ বার ঠাণ্ডা পানিসহ খেয়ে গেলে পাতলা পায়খানা দ্রুত প্রশমিত হয়।

৩. রক্তক্ষরণ রোধে : শরীরে কোন স্থান কেটে রক্ত রেরুতে থাকলে উক্ত কাটা স্থানে বহেড়ার মিহি চূর্ণ প্রলেপ দিলে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।

৪. হজমশক্তি বৃদ্ধি ও ক্ষুধামন্দায় : প্রতিবার ৫-৬ গ্রাম বহেড়ার খোসা চূর্ণ আহারের পর দিনে ০২(দুই) বার সেবন করে গেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি ও ক্ষুধামন্দায় বিশেষ উপকার হয়।

৫. মাথা ব্যথা ও মস্তিস্কের দূর্বলতায় : প্রতিবারে ৫(পাঁচ) গ্রাম বহেড়ার খোসা চূর্ণের সাথে ৩-৪ চা চামচ মধু সেবন করলে মাথা ব্যথা ও মস্তিষ্কের দূর্বলতায় বিশেষ ফলপ্রদ।

৬. বহেড়া বীজের শ্বাস অল্প পানি দিয়ে মিহি করে মুখে রাখলে দাঁতের মাড়ির ক্ষত ভাল হয়।

৭. কোথাও ফুলে গেলে বা কেটে গেলে বহেড়া মিহি করে বেটে প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়।

৮. এই গাছের ফল কোষ্টকাঠিন্য, জন্ডিস, কাশি এবং রক্তক্ষরণ বন্ধে ব্যবহৃত হয়।

৯. ফলের ভিতরের অংশ ডায়রিয়া, আমাশয় এবং পাইলস নিরাময়ের জন্য বেশ কার্যকরী।

১০. বীজ থেকে উৎপাদিত তৈল মালিশ করলে বাত সেরে যায়। বহেড়ার ফল ত্রিফলার একটি উপাদান। ১১. বিরোচক ও সংকোচন ওষুধ হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

১২. দীর্ঘস্থায়ী জ্বর ও শ্বাসনালীর প্রদাহের জন্য এটি ব্যবহার করা যায়।

১৩. চোখের অসুখ এবং বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের কামড় ইত্যাদিতে বহেড়া ব্যবহার হয়।

১৪. ত্রিফলা অর্থাৎ আমলকি, হরিতকি, বহেড়া-এর প্রতিটির সমপরিমাণ গুঁড়ার শরবত কোলষ্টেরল কমাবার অর্থাৎ ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ কমাবার মহৌষধ। এক ঔষধ গবেষক দলের মতে, আধুনিক যে কোন এ্যালোপ্যাথিক ঔষধের তুলনায় ত্রিফলা কোলেষ্টেরল কমাবার ক্ষেত্রে অনেক বেশী ফলপ্রসূ।।

সাধারণ ব্যবহার : বাসকের পাতার সবুজ সার এবং হলুদ রং তৈরীর কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, পাতার বিভিন্ন Alkaloid থাকায় ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক হিসেবে ফল প্যাকিং ও সর্টিং-এর কাজে ব্যবহৃত হয়।

সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পদ্ধতি :

ফল পেকে গাছের তলায় আপনাআপনি ঝরে পড়ে। বস্তুতঃ তখনই বহেড়ার ফল সংগ্রহ করতে হয়। পরবর্তীতে শুকিয়ে ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিলে ১(এক) বৎসর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং এর কার্যকারিতা অটুট থাকে।

রাসায়নিক উপাদান : এ যাবৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে যে সকল রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গিয়েছে তা নিম্নে বর্ণিত হলো : ফলে ট্যানিন (Tannin) রয়েছে যা গ্যালো-ইলাজিট্যানিক এসিডের (Gallo-ellagitanjic acid) সমন্বয়ে তৈরী। এতে থাকে ফাইলেমব্লিন (Phyllemblin), বিটাসিটোস্টেরল (Betasitosterol), ম্যানিটল (Mannitol), চিনি (Sugar), হাইড্রোকার্বন (Hydrocarbon), টেট্রাইয়াকেনটেন (Tetratriaconatane), ডাইট্রাইয়াকটানোল (Ditriacontanol), ট্রাইট্রিয়াকনটানোন (Tritriacontanone), হেক্সাহাইড্রক্সি-ডাইফেনিক এসিড এস্টার (Hexahydroxy Diphenic acid ester), রেজিন (Resin) এবং সবুজাভ হলুদ তেল (Green yellow oil) যাতে থাকে পালমিক (Palmic), ষ্টিয়ারিক (Stearic), অলিয়িক (Oleic) ও লিনোলেইক এসিড (linoleic acid) কাঠ, বাকল ও ফলে থাকে ইলাজিক এসিড (Ellagic acid) বাকলে আরো থাকে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সালিক এসিড (Oxalic acid), বীজের উপরাংশে থাকে গ্যালিক এসিড (Gallic acid) ।

বাজার চাহিদা : ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি করার ক্ষেত্রে বহেড়া প্রচুর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ত্রিফলার একটি অন্যতম হলো বহেড়া। বর্তমানে দেশের ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্পে বছরে প্রায় ৫০০ টনের অধিক বহেড়া প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত ও পরিকল্পিতভাবে বহেড়া গাছ চাষাবাদ করা হলে এসব ওষুধ শিল্পগুলো আরো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে এবং বহেড়া বিদেশে রপ্তানী করাও সম্ভব হবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *