প্রচলিত নাম : বাইন
ইংরেজী নাম : Baen
বৈজ্ঞানিক নাম : Avicennia officinalis Linn.
পরিবার : Verbenaceae
পরিচিতি : বাইন বড় আকারে চিরসবুজ বৃক্ষ। সাধারণতঃ ১৫-২০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। এটা সুন্দরবনের নদীর পাড়ে বা ভিতরে নীচু এলাকার পাড়ে জন্মে থাকে। বয়সী বাইন গাছ সাধারণতঃ অধিক ডালপালা বিশিষ্ঠ ঝোপাকৃতির ও ফাপা কান্ড বিশিষ্ঠ হয়। বাইন গাছের পাতা ডিম্বাকৃতির বা বড় ধরনের উপবৃত্তাকৃতির এবং পাতার উপরিতল গাঢ় সবুজ রংয়ের এবং নীচের দিকটা সবুজাভ হলুদ বর্ণের। এ গাছের ফুলের রং কমলা হলুদ বর্ণের , ১০-১২ মিলিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট হয়ে থাকে। মার্চ-জুন মাসে ফুল আসে এবং ফল পাকে জুলাইআগস্ট মাসে । ফলের অংকুরোদগম কখনো গাছেই হতে দেখা যায় আবার কখনো মাটিতে পড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই হয় ।
বিস্তৃতি : সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়।
বাইন বীজ সগ্রহের সময় : বাইন গাছের ফুল মে-জুন মাসে ধরে। ফল আগস্ট মাসে পরিপক্ক হয়। ফলে একটি বীজ থাকে। ফল পড়ার পরপরই অংকুরিত হয়। অনেক সময় গাছে থাকাকালীন বীজের অংকুরোদগম হয়।
বাইনের বীজ সম্পর্কে কিছু তথ্য :
উপকুলীয় বন হতে সংগৃহীত বীজ হতে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া গেছে। যথা:
১. বীজের ওজন : ৩.৩ গ্রাম হতে ৬.৬ গ্রাম।
২. প্রতি কিলোগ্রামে বীজের সংখ্যা : গড়ে ৩০০টি।
৩. বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা : ৯০% (বীজ সংগ্রহের ১০ দিনের মধ্যে মাঠে লাগানোর পর বা নার্সারী বেডে)
বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি : বাইনের জন্য পূর্ব অংকুরিত বীজ রোপণ সবচেয়ে উত্তম। জোয়ারের সময় গাছের নীচে ছোট নৌকা নিয়ে গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করা ভাল। এছাড়া, জোয়ারের সময় যেখানে বাইন গাছ বেশী সেখান হতে জাল দিয়ে বীজ সংগ্রহ করা হয়। জোয়ারের পানি হতে সংগৃহীত বীজগুলি প্রায়ই পূর্ব অঙ্কুরিত । পরিপক্ক ফল ফেটে যায় এবং মূল বাহির হতে দেখা যায়।
বীজ পরিশোধন : একটি কথা মনে রাখতে হবে, পূর্ব অঙ্কুরিত বীজ রোপণ করলে সফল বাগান উত্তোলন সম্ভব। এছাড়া, আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বীজগুলি কোনক্রমেই স্তুপাকারে রাখা যাবে না। কারণ বীজ সংগ্রহের পরই বীজের অঙ্কুরোদগম আরম্ভ হয়ে যায় এবং স্তুপাকারে রাখলে বীজগুলি সহজেই পচে যায়। কাজেই বীজ সংগ্রহ করে জোয়ার-ভাটার পানিতে সংরক্ষণ করতে হবে। এ সংরক্ষণ এমন জায়গায় করতে হবে যেখানে মরা কটাল ও ভরা কটালের জোয়ারের পানি যাতায়াত করে। জোয়ারের বা ভাটার টানে বীজ যাতে ভেসে না যায় সেজন্য বীজ সংরক্ষণের জায়গাকে জাল দিয়ে উঁচু করে ঘিরে দিতে হবে। এভাবে ৫-৬ দিন রাখতে হবে। বীজ ৩-৪ দিনের ভিতরেই অঙ্কুরিত হতে আরম্ভ করে। এই অঙ্কুরিত বীজ সরাসরি , বাগানে বা নার্সারী বেডে লাগাতে হবে।
বাইনের জন্য স্থান নির্বাচন :
বাইন চারা রোপণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে :
১. বাগান এলাকা তুলনামূলকভাবে নতুন চর হতে হবে এবং উহার অবস্থান লবনাক্ত অঞ্চলে হতে হবে, যেখানে পানির গড় লবনাক্ততা ২০-৪০ পি.পি. টি পর্যন্ত থাকে।
২. ঐ স্থানে জোয়ার-ভাটার পানি মরা কটালে ও ভরা কটালে যাতায়াত করতে হবে।
৩. পানির সাথে আসা প্রচুর পরিমাণ পলিমাটি জমতে হবে এবং নতুন চর হলে উরিঘাস থাকতে হবে।
৪. তাছাড়া ঐ স্থানে কোনক্রমে পানি জমে থাকতে পারবে না। কাদা ও দো-আঁশ মাটি বাইন গাছের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। বাইন গাছ রোপণের পূর্বে এগুলি বিবেচনা করে স্থান নির্বাচন করা উচিত।
৫. তুলনামূলকভাবে পুরাতন চর হলে ভাল হয়। তবে অধিক উরিঘাসযুক্ত এলাকা বাগানের জন্য নির্বাচন করা যাবে না। এতে ছোট চারা ঘাসের উপদ্রবে মারা যায়।
বীজ রোপণ পদ্ধতি :
দুইভাবে বাইনের বীজ রোপণ করা হয়ে থাকে :
১. মাটিতে বীজ পুঁতে দেওয়া (ডিবলিং)
২. বীজ ছিটিয়ে দেওয়া (ব্রডকাস্টিং)
অঙ্কুরিত বীজ ও সাধারণ বীজ উপরোক্ত দুই পদ্ধতিতে রোপণ করা যায়। তবে বীজ মাটিতে পুঁতে দেওয়া ভাল। এতে বীজ জোয়ারের বা ভাটার টানে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বীজগুলি থলি জায়গা লাগাতে হয়। রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে বীজের ৩/৪ অংশ যেন মাটির ভিতর থাকে এবং চার দিকের মাটি টিপে শক্ত করে দিতে হবে। এছাড়া, বীজের গায়ে জখম করা চলবে না।
চারা সংগ্রহ ও চারা রোপণ :
(১) বাইনের জন্য বীজতলায় চারা উৎপাদন করে বাগানে লাগানো যায়। এক্ষেত্রে বীজ সংগ্রহ করে বীজগুলি কাদাযুক্ত সীড বেডে বা নার্সারী বেড়ে ফেলতে হয়। চারাগুলি যখন ১-২ মাস বয়স হবে এবং দুই পাতার হয় তখনই চারাগুলিকে টেনে তুলে বাগানে লাগাতে হবে। এভাবে চারা লাগালে চারা জোয়ার-ভাটার টানে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নার্সারী বেডে ১০ মাস বয়সের চারা (৭০-৯০ সে.মি. উচ্চতা ) মাঠে লাগালে জীবিতের হার অধিক হয়।
(২) বাইন গাছের নিচে প্রচুর চারা পাওয়া যায়। এ সমস্ত চারা হতে ২/৪ পাতা বিশিষ্ট চারা সহজেই মাটি থেকে টেনে তোলা যায় এবং প্রধান মূল নষ্ট না করে বাগানে লাগানো যায়। এতেও সফল বাগান সৃষ্টি সম্ভব। তবে এ চারাগুলি বাগানে প্রেরণের সময় খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যাতে করে স্তুপাকারে চারাগুলি পঁচে না যায়।
(৩) সাম্প্রতিককালে বন গবেষণাগারের উদ্যোগে পলিব্যাগে সরাসরি বীজ বপন করা চারা উত্তোলন করা হচ্ছে। পলিব্যাগে নার্সারীর অবস্থান নার্সারীর বেডের মতো হয় যেখানে জোয়ার-ভাটার পানি আসে। ১০ মাস বয়সের চারা পলিব্যাগে মাঠে লাগিয়ে, ৯৫% জীবিত চারা পাওয়া যায় এবং বাগান ভাল হয়।
চারা রোপণের দূরত্ব : কেওড়া গাছের ন্যায় বাইন গাছের চারা ৪’ X ৪’ অথবা ৫’X ৫’দূরত্বে লাগান হয়। জোয়ারের সময় সাধারণতঃ চরের নীচের দিক হতে বীজ বা চারা রোপণ করতে করতে উপরের দিক উঠাতে হয়। আর ভাটার সময় উপর হতে নীচের দিকে যেতে হয়। এতে সময় সংক্ষেপ করা যায়। যদি কোন স্থানে উরি বা অন্য কোন ঘাস থাকে সেখানে বাইন না লাগানো ভাল। যদি লাগাতে হয়। তবে থালা করে ঘাস বা উরির মোথা সম্পূর্ণরুপে উঠায়ে তবে বাইন রোপণ করা উচিত। অন্যথায় সফল বাগান হওয়া দুষ্কর ।
বাগানের যত্ন : কেওড়া বাগানের ন্যায় বাইন বাগানের যত্ন প্রায় ২/৩ বৎসর নিতে হবে। অন্যথায় বাগান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশী নিয়মিতভাবে শূন্যস্থান পুরন ও আগাছা বাছাই করতে হবে। বাগানে যাতে গরু যেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
সাধারণ ব্যবহার : কাঠ ভংগুর । সাধারনভাবে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত। বাইন ফুলে ভাল মধু পাওয়া যায়। এছাড়া সস্তা বীম ও দরজা জানালার চৌকাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।