গাছপালা

রসুন

প্রচলিত নাম : রসুন

ইংরেজী নাম : Garlic

বৈজ্ঞানিক নাম : Alliunn sativum Linn.

পরিবার : Liliaceae

পরিচিতি : রসুন একটি কন্দাল বর্ষজীবী উদ্ভিদ। একাধিক কোয়া বা কন্দবিশিষ্ট সাদা শল্কপত্রাবৃত অংশটুকু মাটির নীচে থাকে এবং সবুজ পাতাসহ লম্বা পুষ্পদণ্ড (কলি) মাটির উপরে থাকে। রসুনের কথা মনে পড়তেই ধবধবে সাদা শল্কপত্র ও একগুচ্ছ মূলের ছবি ভেসে ওঠে।

রসুন ও এর দুর্গন্ধের বিষয়ে অথর্ববেদ, সংহিতা ও প্রাচীন বিভিন্ন কাহিনীতে উল্লেখ আছে। পেঁয়াজের সাথে রসুনের তফাৎ হলো যে পেঁয়াজ এক কন্দাল এবং শল্কপত্র লাল। রসুনের একাধিক কন্দ একসঙ্গে গুচ্ছমুলের সাথে যুক্ত থাকে। এছাড়া রসুনের কলি পেঁয়াজের কলি অপেক্ষা ছোট এবং সরু।

বিস্তৃতি : বাংলাদেশ, ভারত ও সংলগ্ন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এমনকি পৃথিরীর অন্যান্য মহাদেশেও এর চাষ করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই এর চাষ হয়।

বীজ বা কন্দ সগ্রহ সময় : মার্চ-এপ্রিল।

বীজ আহরণ চারা উত্তোলন : সাধারণতঃ জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে সাদা থোকায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফোটে। মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকা বীজ বা কন্দ সংগ্রহ করা হয়। বীজ রোদে শুকিয়ে এবং বাছাই করা বীজ/কন্দ পরবর্তী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে সরাসরি জমিতে রোপণ করা হয় অথবা বীজ আগে বীজতলায় বপন করে চারা তৈরী করে পরে মাঠে রোপণ করতে হয়। কন্দের আগে বীজতলায় বপন করে চারা তৈরী করে পরে মাঠে রোপণ করতে হয়। কন্দের ক্ষেত্রে সফলতার হার বীজের তুলনায় অনেক বেশী (৮০%-৮৫%)। এসময় এক কন্দ বিশিষ্ট ছোট চারা রোপণ করলে এপ্রিল-মে মাসে রসুন আহরণ করা যায় । বেলে-দোআঁশ মাটিতে রসুন ভাল জন্মে। রোপণের পূর্বে জমিতে ভালভাবে চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে নিতে হয়।

ঔষধি ব্যবহার : রসুনের ঔষুধি গুণ সম্বন্ধে পাশ্চত্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক Hippocrates লিখেছেন যে, আমাদের বনৌষধির মধ্যে রোগ প্রতিকারে রসুনের স্থানই প্রথম।

ছয়টি রসের মধ্যে রসুনে পাঁচটি আছে বলে এর নাম হয়েছে রস+উণ (কম) = রসুন। কন্দে কটু, পাতায় তিক্ত, পুস্পনালে (কলি) কষায়, তার আগার লবন এবং বীজে মধুর রস রয়েছে। যেটি নেই সেটি হল অম্ল রস। প্রমাণ করা যায় এভাবে যে-দুধে রসুন দিলে দুধ কাটে না । উল্লেখ্য যে, ঔষধার্থে ও আহার্য হিসেবে রসুনের কন্দ থেকে বীজ পর্যন্ত সকল অংশই ব্যবহার করা হয় এবং এর প্রতিটি অংশই পৃথক পৃথক গুণের অধিকারী। এছাড়াও রসুনে ভিটামিন এ, বি, সি ও ডি আছে।

আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালি ভট্টাচার্য বলেছেন, রসুন সূক্ষ্মস্রোতগামী তাই পারদের মত সর্বশরীরে ব্যপ্ত হতে পারে বলেই গায়ে গন্ধ বের হয়। এটি মেধা, স্মৃতি, বল ও আয়ুবর্ধক। পুরুষের পক্ষে শুক্র ও ওজোধাতুর বর্ধক, পৌরুষ প্রকৃতির ধারক ও বাহক। নারীর পক্ষে সন্তানপ্রদ ও আয়ুকর। যুবতীর অঙ্গসৌষ্টবের সমতা রক্ষক এবং কিশোরের পক্ষে শরীর ও মনের সার্বিক উন্নতিকর। রসুনের মধ্যে থাকায় এই কন্দটির সর্বপ্রকার জীবাণুনাশ করার শক্তি আছে। একটা রসুন থেঁতো করে ঘরে রেখে দিলে ঘর জীবানুমুক্ত থাকে।

বেশ আগে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় রসুনের উপর এক সেমিনার হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রসুনের উপর যে গবেষণা হয়েছে। তা উপস্থাপিত হয় সেখানে জার্মানিতে ৮০ জন Blood pressure-এর রোগীকে রসুন দেওয়া হয়; তাদের প্রায় সকলেই উক্ত রোগের উপকার পেয়েছেন। জাপানে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রসুনে বি-কোলাই ও টাইফয়ডের জীবাণু নাশ করার শক্তি আছে।

ব্রাজিলের একদল চিকিৎসক রসুন প্রয়োগ করেছেন Amebic dysentry, Typhoid ও Paratyphoid রোগের ক্ষেত্রে। রাশিয়ার চিকিৎসকগণ বলেছেন, রসুনের দ্রব্যশক্তি পেনিসিলিনের তুল্য।

অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা কেন্দ্র ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধ ও শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে রসুনের কার্যকারিতার কথা উল্লেখ করেছে। ১৯২৯ সালে জার্মানীর বিজ্ঞানীরা একমত প্রকাশ করেন যে, রক্ত পরিস্কার ও নতুন রক্ত কণিকা প্রস্তুতে রসুনের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

চরক ও সুশ্রত সংহিতার মতে ১। ক) স্বল্প মেধায়, খ) বিস্মরণে, গ) কৃমিতে, ঘ) রাতকানায়, ঙ) শুক্র-তারল্যে, চ) পাথুরী রোগে, ছ) জীর্ণ জ্বরে ও জ) শরীরে জড়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুই বা এক কোয়া রসুন চিবিয়ে খেয়ে একটু গরম দুধ খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।

২) যখন পুরনো জ্বর ছাড়ে না বাড়ে বা কমে কিন্তু একটু থেকেই যায়, তখন ৫/৭ ফোঁটা রসুনের রসের সাথে আধা কাপ গাওয়া ঘি মিশিয়ে খেলে ২/৪ দিনের মধ্যেই জ্বর কমে যায়।

৩) অল্প গরম দুধের সাথে ২/১ কোয়া রসুন বাটা খেলে শুক্রতারল্য হয় না। শরীরের নিত্য ক্ষয় রোধ হয় ও অস্থির বল বাড়ে।

৪) পেটের বায়ুতে ঠাণ্ডা পানিতে ২/৪ ফোঁটা রসুনের রস মিশিয়ে খেলে অনেক ক্ষেত্রে উদ্বেগ চলে যায়। ৫)। সরিষার তেলে রসুন ভেজে সেই তেল মালিশ করলে বাতের যন্ত্রণা কমে যায়।

৬)। সর্দি হয় না অথচ মাথা ধরে, এরকম হলে ২/১ ফোটা রসুনের রসের নস্যি নিলে উপকার পাওয়া যায়।

৭) ক্ষতের ক্লেদ/পচা অংশ কিছুতেই যেতে চায় না, এরূপ হলে রসুন বাটা ক্ষতে লাগালে কেটে যাবে। গরু-মহিষের ক্ষতে পোকা পড়লেও এতে সেরে যায়।

৮) রক্তের কোলস্টেরলের মাত্রা কমাতেও রসুনের ভূমিকা কার্যকরী।

৯) বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের এক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মতে, রসুনের রস নারকেল বা সরিষা বা তিল তেলের সাথে মিশিয়ে নিয়মিত মাথায় ব্যবহার করলে চুল পাকা বন্ধ হয়। রসুন বেটে মাথায় প্রলেপ দিলে টাকপড়া বন্ধ হয়।

১০) আমাশয় হলে সকাল বিকাল এক কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

১১) চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখ আছে-রসুন যৌবন রক্ষায় এমনকি ঢলেপড়া যৌবনে বিশেষ কার্যকরী। উক্ত মতে কাঁচা আমলকির ২/১ চা চামচ রসের সাথে ৩/৪ কোয়া রসুন বাটা খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গাওয়া ঘিয়ে রসুনের কোয়া ভেজে মাখন লাগিয়ে নিয়মিত খেলে ঢলেপাড়া যৌবন রক্ষা হবে। এটি খাওয়ার পরে গরম পানি খাওয়া উত্তম।

১২) ভেষজ বিজ্ঞানী ড. আব্দুল গনি লিখেছেন রসুন ডায়াবেটিস রোগের কার্যকরী ওষুধ। এছাড়াও এটি উদ্দীপক, কৃমিনাশক ও মূত্রবর্ধক হিসেবে ফলপ্রসূ। রসুনের রস বায়ুনাশক, কাশি বহিকারক, তলপেটের ব্যথা নিবারক।

রসুনের এত গুণ হওয়া সত্ত্বেও এর তীব্র গন্ধের জন্য অনেকে খেতে চান না। এক্ষেত্রে রসুনের কোয়ার উপরের খোসা ছাড়িয়ে আধখানা করে কেটে আগের দিন রাতে টক দইয়ে ভিজিয়ে রেখে পরদিন খেলে গন্ধ থাকে না। এছাড়া, আধা রসুনের কোয়া ঘিয়ে ভেজে নিলেও গন্ধ থাকে না।

সাধারণ ব্যবহার : রসুনের কন্দ, কলি, পাতা ইত্যাদি সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

রাসায়নিক উপাদান : a) Organic sulphides viz. allyl propyl disulphide, diallyl disulhide, allicin, allisatin-1, allisatin11, b) Sulphur bearing amino acid, c) Essential oil.

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *