গাছপালা

শতমূলী গাছ

প্রচলিত নাম : শতমূল

ইংরেজী নাম : Asparagus

বৈজ্ঞানিক নাম : Asparagus racemosus Linn

পরিবার : Liliaceae

পরিচিতি : শতমূলী বীরুৎ প্রকৃতির উদ্ভিদ যা দেশের সর্বত্র বন-জঙ্গলে জন্মায়। শতমূলী বহুবর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ। কোন বড় গাছকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। এগাছের লতায় বাঁকানো কাঁটা থাকে। সরু মূলা বা গাজরকে একসঙ্গে বেঁধে রাখলে যেমন দেখায়, শতমূলীর শেকড়কে ঠিক সে রকমই দেখায়। শতমূলী গাছের পাতাগুলো সরু সুতোর মতো দেখায়। সেজন্য কিছুটা দূর থেকে এটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে। অনেকে শোভাবৃদ্ধির জন্য সখ করে বাড়ির সামনে বাগানে ফুলগাছের সঙ্গে শতমূলী গাছ লাগিয়ে থাকেন এবং কোন বড় গাছ থাকলে এ লতা নিজে থেকেই তাকে জড়িয়ে বড় হয়।

বিস্তৃতি : বাংলাদেশের সর্বত্র।

চাষাবাদ পদ্ধতি : বংশ বিস্তারের জন্য বীজই প্রধান মাধ্যম উফ, নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ এবং বালুযুক্ত মাটিতে এ গাছটি ভাল জন্মায়। বর্ষার শুরুতে গাছে ফুলের মঞ্জুরী আসে। পাকে ফাল্গুনে। ফলের আকার অনেকটা মটর দানার সমান। কাঁচা অবস্থায় ফলের রং সবুজ পাকা ফলের রং লাল হয়ে যায়। পাকা ফলে একটা সুগন্ধি রয়েছে। শতমূলী দো-আঁশ এবং বেলেমাটিতে খুব ভাল হয়। একটা পুরানো গাছ থেকে ১০/১২ কেজি মূল পাওয়া যায়। বীজ বপনের পূর্বে এটিকে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম হতে ১০-১৫ দিনের মতো সময় লাগে। এর অঙ্কুরোদগমের হার শতকরা ৭০-৮০ ভাগ। অঙ্কুরিত চারার বয়স দুই থেকে তিন মাস হলে তা বপন করতে হয় ।

ঔষধি ব্যবহার :

. রক্ত দূষিত হলে : নানা কারণে আমাদের শরীরের রক্ত দূষিত হয়ে নানা ব্যাধি সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চুলকানী,দাদ, ফোড়া, খোস-পাঁচড়া, শুক্ৰধাতু তরল হওয়া, বহুমূত্র, দুষ্টব্রণ, বাতব্যাধি ইত্যাদি। ২/৩ গ্রাম শতমূলীর গুঁড়ো রোজ সকালে ঠান্ডা পানির সঙ্গে একবার খেলে দুষিত রক্ত পরিস্কার হয়ে যাবে ।

. রাতকানা রো : এ রোগে আক্রান্ত হলে চারা থেকে ছয় গ্রাম শতমূলীর টাটকা পাতা সামান্য গাওয়া ঘি দিয়ে ভেজে রোজ সকালে একবার করে খেলে এর রোগের হাত থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

. মায়ের বুকের দুধ বাড়াতে : দশ মি. মি. টাটকা শতমূলীর রস, ৫০ মিলিলিটার জ্বাল দেয়া গরুর দুধ, এক-দেড় চামচ চিনি,এ তিনটি এক সঙ্গে মিশিয়ে দিনে দু’বার করে খেতে হবে। প্রথমবার সকালে এবং দ্বিতীয়বার সন্ধ্যার পর। প্রতিবারেই পরিমাণ একই থাকবে। মাত্র ২/৩ দিন খেলেই শতমূলীর সুফল পাওয়া যাবে।

. প্রস্রাবে কষ্ট : পাথুরী নয় অথচ প্রস্রাব করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া প্রস্রাবের পরিমাণও যথেষ্ট কমে গেছে। এ অবস্থায় শুকানো করা শতমূলীকে গুঁড়ো করে দেড় গ্রাম ঠাণ্ডা পানির সঙ্গে সকালে একবার এবং বিকেলে আরেকবার খেলে প্রস্রাবে কষ্ট | থাকবে না, পরিমাণও স্বাভাবিক হবে। তবে পানি বেশি করে খাওয়া দরকার ।

. স্বপ্নদোষ : শতমূলীর রস একটা স্টীলের কড়াইতে রেখে তাতে ১০০ মিলিলিটার গাওয়া ঘি দিয়ে পাক করতে হবে। তিন গ্রাম এ ঘি, আধা কাপ সামান্য গরম গরুর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে সকালে একবার এবং বিকেলে আরেকবার মোট দু’বার খেলে রোগটি সম্পূর্ণ সেরে যাবে। তবে নিজেও কিছুটা সংযত হবার চেষ্টা করতে হবে ।

. স্নায়ুশক্তি বৃদ্ধি শারীরিক দুর্বলতায় : শতমূলীর রস (কাঁচা) ১৫-২০ মি. লি. (৩-৪ চা চামচ) ১(এক) গ্লাস পরিমাণ দুধের সাথে মিশিয়ে সকাল-বিকাল সেব্য। উল্লিখিত নিয়মে ১০-১৫ দিন সেবন করে যাওয়া আবশ্যক।

৭. শুক্রমেহ স্বপ্নদোষ প্রশমনে : ১০ গ্রাম পরিমাণ শতমূলী চূর্ণ প্রত্যহ ২ (দুই) বার দুধসহ সেব্য। উল্লিখিত নিয়মে ১ (এক) মাস সেবন করে যেতে হবে।

. স্তন্য দুগ্ধ বৃদ্ধিতে : ৫ গ্রাম পরিমাণ শতমূলী চূর্ণ ও ৫ গ্রাম অশ্বগন্ধা চূর্ণ একত্রে মিশিয়ে প্রত্যহ ২ (দুই) বার দুধসহ সেব্য। উল্লিখিত নিয়মে ১ (এক) মাস সেবন করে যেতে হবে ।

. স্বল্পতা : শতমূলীর রস ১৫-২০ মি.লি. (৩-৪ চা চামচ) ১(এক) গ্লাস পরিমাণ ডাবের পানির সাথে মিশিয়ে প্রত্যহ ২ বার সেব্য। উল্লিখিত নিয়মে ৫-৭ দিন সেবন করে যেতে হবে।

অন্যান্য :

১. এই গাছের টিউবার জাতীয় মূল থেকে টনিক তৈরী হয় যা কামোদ্দীপক।

২. এছাড়া ডিসপেসপিয়া, আমাশয় এবং ডায়রিয়া প্রতিরোধেও এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

৩. টিউবার থেকে টনিক মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ও চুল পড়া বন্ধে এটি কার্যকরী।

৪. এছাড়া জন্ডিস, মূত্রবর্ধক এবং ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্যেও এটি বেশ উপকারী।

৫. এই গাছের বাকল থেকে ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাস প্রতিরোধক ঔষধ তৈরী হয়।

উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি : সাধারণত উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে শতমূলী গাছ ভাল জন্মে। তবে দো-আঁশ ও বেলে মাটিতে ইহা ভাল জন্মায়।

সংগ্রহ সংরক্ষণ পদ্ধতি : বীজ সংগ্রহ করে ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রৌদ্রে শুকিয়ে শুষ্কস্থানে রেখে ১ (এক) বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং এর কার্যকারিতা অটুট থাকে। একইভাবে বাজারজাতকরণ করা যাবে।

ঔষধি গুণাগুণ : স্নায়ু শক্তিবর্ধক, বলকারক, শুক্রগাড়কারক, স্তন্যদুগ্ধ বর্ধক। মূত্র কৃচ্ছতা, গণোরিয়া, শুক্রমেহ, শারীরিক দুর্বলতা এবং স্বপ্নদোষ নিরসনে উপকারী।

রাসায়নিক উপাদান : শতমূলীতে ৪টি স্যাপেনিন রয়েছে- Shatavarin I, II, III, IV, ফুল এবং পরিপক্ক ফলে Quercertin (কিউরসেটিন), Rutin (রুটিন) এবং Hyperoside (হাইপারোসাইড) রয়েছে। পাতায় রয়েছে Diosgenin (ডায়োসজেনিন) এবং Quercetin- 3 glucuronide (কিউর সেটিন-৩ গ্লুকোরোনাইড)।

সাধারণ ব্যবহার : শতমূলী লতানো উদ্ভিদ বিধায় অনেকে বাগানে এবং বাড়ির আঙ্গিনায় শোভা বৃদ্ধির জন্য এ গাছটি লাগিয়ে থাকেন।

বাজার চাহিদা : ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শিল্পে বিভিন্ন ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে শতমূলীর ব্যবহার সর্বাধিক। পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব ঔষধ শিল্পে প্রতি বছর প্রায় ২০০ টনের অধিক শতমূলী ব্যবহৃত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *