লিচু গাছ
প্রচলিত নাম : লিচু
ইংরেজী নাম : Litchi
বৈজ্ঞানিক নাম : Litchi chinenses Sonner.
পরিবার : Sapindceae
পরিচিতি : মাঝারী আকারের চিরসবুজ বৃক্ষ। উচ্চতায় ২০ মিটার পর্যন্ত হয়। বাকল ধূসর-সাদা, মসৃণ। পত্র যৌগিক, ঘন, সবুজ, উজ্জ্বল ও মসৃণ। পত্রক ৮-১২ সে.মি. লম্বা হয়। ফুল সাদা ও ছোট। ফুল ৪-৫ সে. মি. লম্বা ডিম্বাকৃতির, ত্বক কাঁটার মতো অমসৃণ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু ফলসমুহের মধ্যে লিচু অন্যতম। গন্ধ, রস ও স্বাদের মাধুর্যে দেশ-বিদেশে লিচু জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। লিচু একটু যত্ন নিলেই জন্মোনো যায় । ফলটি খাদ্যগুণেও সমৃদ্ধ। লিচ্চ এ ফলের চৈনিক নাম । টাইনেন্সিস অর্থ চীন দেশীয়।
বিস্তৃতি : লিচু দক্ষিণ চীনের ফল। পৃথিবীতে লিচু চাষের বিশেষ প্রসার হয়নি জলবায়ুর কারণে। এশিয়া মহাদেশের চীন, ইন্দোচীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, জাপান, তাইওয়ান, মরিশাস, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে লিচু জন্মায়। চীন দেশেই সর্বাধিক পরিমাণে লিচু উৎপাদান হয়। অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রাজিল। আমেরিকান যুক্তরাষ্টের হাওয়াই ও ফ্লোরিডা রাজ্যেও লিচুর চাষ হয়ে থাকে।
জাত : লিচুর বেশ কিছু জাত-প্রকরণ দেখা যায়। প্রত্যেকটি জাতের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঢাকা ও ময়মনসিংহে কয়েকটি ভালো জাতের লিচুর চাষ হতে দেখা যায়। চায়না, বোম্বাই, এলাচী, মঙ্গলবাড়ী প্রভৃতি কয়েকটি জাত বাংলাদেশে চাষ হয়। চায় নানান জাতের গাছটি মাঝারি আকারের বা খাটো, পাতা তুলনামূলকভাবে ছোট। শাস খুব মিষ্টি, রসালো ও সুগন্ধযুক্ত, বীজ বেশ ছোট, শাঁসের চৌদ্দ ভাগের এক ভাগ। রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোহর ও রংপুর এলাকায় এর চাষ হয়। যশোহর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে বোম্বাই নামক জাতটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ফল আকারে বড়, বর্ণ আকর্ষণীয়, সুগন্ধযুক্ত ও শাস মিষ্টি। গাছ ৬৭ মিটার উচু হয়। প্রতি গাছে ৮০-৯০ কেজি ফলন হতে পারে। ফলের বর্ণ আকর্ষণীয় কিন্তু শাস কিঞ্চিৎ টক ভাবাপন্ন।
মাটি ও জলবায়ু : মাটি সম্বন্ধে লিচু খুব বেশী সচেতন না হলেও জৈব পদার্থযুক্ত গভীর দো-আঁশ পলিমাটি ও বেলে দো-আঁশ মাটিই লিচু চাষের উপযুক্ত। মাটির পানি ধারন ক্ষমতা ও জমির নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো হওয়া চাই। বেশী অম্ল ও ক্ষারীয় মাটি লিচু চাষের জন্য ভালো নয়। এজন্য মাটির বিক্রিয়া অল্প অল্প থেকে নিরপেক্ষ বা অল্প ক্ষার হাওয়া যুক্তিযুক্ত (PH 6.0-8.0) । মাইকোরাইজা এক প্রকারের ছত্রাক, শিকড়ে আবুদ সৃষ্টি করে তথায় বাস করে এবং লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করলে দ্রুত মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয়। উপক্রান্তীয় অঞ্চলে লিচু ভালো হয়। দক্ষিণ চীনে শীতকালে তুষারপাত হয় না, গ্রীষ্মকালে গরম ও শুকনো বাতাস বহে না, বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১৫০ সে. মিটার মতো এবং বাতাসের আর্দ্রতা ৭০ হতে ৮৫% কাজেই এ অঞ্চলে লিচু খুব ভালো হয়। সেজন্য উপ-নিরক্ষীয় জলবায়ু লিচু চাষের উপযোগী বলে ধরে নেয়া হয়।
চারা তৈরী : লিচুর গুটি কলম খুব ভালো হয়। জানা জাতের গাছের দেড় থেকে দুই সে.মি. ব্যাসযুক্ত সোজা ডালে জুন মাসে গুটি কলম করলে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জামিতে চারা রোপণ করা চলে। কিন্তু গুটি কলম দিয়ে তৈরী লিচুর চারার শিকড় অত্যান্ত স্পর্শকাতর। এজন্য চারা সরাসরি বাগানে রোপণ করাই ভালো। টবে বা পলিথিনের থলিতে লাগিয়ে শিকড় ভালোভাবে গজালে মাটিসহ রোপণ করা উচিত। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
চারা রোপণ : জমি ভালোভাবে তৈরী করে ৮/১০ কেজি গোবর সার, ১-১.৫ কেজি হাড়ের গুঁড়ো বা ৫০০ গ্রাম টি এস পি ১ কেজি কাঠের ছাই বা ২৫০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ, পুরনো লিচু গাছের মাটি ১.৫ কেজি ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তটি ভর্তি করতে হবে। বর্ষা আরম্ভ হলে চারা বীজতলা থেকে তুলে নির্দিষ্ট জায়গায় লাগাতে হবে। বীজতলা থেকে চারা সাবধানে তুলতে হবে, যাতে শিকড়ে আঘাত না লাগে বা কাটা না যায়। পলিথিনের থলি বা মাটির টব থেকে চারা থলির দুদিক সামান্য কেটে বা কোদালের বাটে টবটি সামান্য আঘাত করে মাটি শুদ্ধ রোপণের স্থানে বসিয়ে দিয়ে চারদিকের মাটি টেনে গর্ত ভরে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হবে। এ সেচ প্রয়োগ শুকনো মৌসুমে নিয়মিত হবে।
সার প্রয়োগ : লিচুর চারা রোপণের পর প্রথম তিন বছর গাছ প্রতি ৩-৪ ভাড় গোবর সার, ৪০০ গ্রাম করে ইউরিয়া ও মিউরেট অব পটাশ ও ৩০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করে উপকার পাওয়া যায়। জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে অর্ধেক ও বাকী অর্ধেক সার প্রয়োগ করতে হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে । ৭ বছর পর সারের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। লিচুর পাতা ঝরে পড়লে গাছের নিচে পচতে দেয়া ভালো, এতে গাছ সতেজ থাকে। লিচু গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও ফল ধারনের নিমিত্তে নাইট্রোজেন ও পটাশ সারের প্রয়োজন বেশী। কিন্তু মাটিতে ফসফরাসের অভাব হলে গাছ বৃদ্ধির ব্যাঘাত হবে, পাতায় তমাটে দাগ হবে। অন্যদিকে মাটিতে পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে পাতার কিনারা শুকিয়ে যেতে পারে। মাটিতে দস্তার অভাব হলে পাতা গুটিয়ে যেতে পারে তাই বসন্তে জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগে উপকার পাওয়া যায়।
সেচ প্রয়োগ : লিচু চাষে পানি সেচের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। ভালো ফলন পেতে হলে পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা থাকতে হবে। গরমের সময়েই লিচু ফল বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই মার্চ মাস থেকে মে পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সেচের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এসম সেচের অভাব হলে ফল ঝরে যাবে । ছোট গাছের চারিদিকে নালা করে সেচ দেয়া ভালো। ফলবতী গাছে সার প্রয়োগের পর এবং গাছে যখন ফল আসে তখন সেচ দিতে হয়। ফল আসার পর ১৫/২০ দিন অন্তর সেচ দেয়া যেতে পারে, তবে বেশী গরম আবহাওয়ায় সেচ কমিয়ে দিতে হবে ।
লিচু বাগানে রোপিত চারা বড় হয়ে দু’গাছের মধ্যবর্তী স্থান ভরাট হতে ৬/৭ বছর সময় লাগে। আন্তঃফসলের চাষ করে এ সময় বাগানের খালি জায়গার সদ্ব্যবহার করা যায়। এর ফলে বাগানে মাটি কর্ষণ ও আগাছা দমনে সহায়ক এবং বাগান মালিক বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পান।
মাধ্যমিক পরিচর্যা : লিচুর শিকড় আমের মতো মাটির গভীরে যায় না। তাই বাগান পরিস্কার রাখার প্রয়োজনে অগভীর চাষ দেয়া বাঞ্ছনীয়। অন্তর্বতী ফসল উৎপাদন বাগান পরিস্কার রাখতে সাহায্য করে। গাছ রোপণের ৩/৪ বছর পর। গাছকে হালকাভাবে হেঁটে দিতে হয়। ফল সংগ্রহ হয়ে গেলে শুকনো ডাল ভেঙ্গে দেয়া হয় । লিচুর ফুল আসে প্রধানতঃ নতুন গজানো ডাল থেকে। তাই পুরাতন ডাল হালকা হেঁটে দিলে ক্ষতির ভয় নেই। কিন্তু বেশী অঙ্গ ছাঁটাই ফুল-ফলের পরিবর্তে শুধু নুতন ডাল ও পাতা গাজাতে সাহায্য করবে ।
ফল সগ্রহ ও ফলন : কলমের লিচু গাছ ৪-৫ বছরের মধ্যেই ফল দিতে আরম্ভ করে যদিও বীজের গাছ থেকে ফল পেতে ৮-১০ বছর সময় লেগে যায়। ভালো ফলন পেতে হলে কলমের গাছেও ৭/৮ বছর লেগে যায়। লিচু গাছের সব ফল প্রায় একসাথেই পাকে এবং ফলের ত্বকে লাল বর্ণ ধারন ফল পাকার লক্ষণ। বাংলাদেশের জলবায়ুতে লিচুর সব জাতই প্রতি বছর ফল ধারন করে। একটি লিচু গাছ ৫০-৬০ বছর বাড়তে থাকে এবং সাথে সাথে ফলন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফল আসার পর থেকে একটি লিচু গাছ ২৫ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে ফলন দিয়ে থাকে, এরপর ফলন কিছুটা কমতে থাকে। ভালো জাতের গাছ বছরে ৩০০০ থেকে ৫০০০টি লিচু উৎপাদন করতে পারে।
সাধারণ ব্যবহার : এ গাছ লিচু ফলের জন্য বিখ্যাত। কাঠ হালকা বাদামী বর্ণের, শক্ত, গাঢ় ও ভারী। তক্তা সস্তা, আসবাপত্র ও বিবিধ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়।