গাছপালা

ঘৃতকুমারী বা ঘৃতকাঞ্চন বা এলোভেরা গাছ

প্রচলিত নাম : ঘৃতকাঞ্চন

ইংরেজী নাম : Indian Aloe

বৈজ্ঞানিক নাম : Aloe barbadensis Mill

পরিবার : Liliaceae

পরিচিতি : ঘৃতকুমারী বর্ষজীবী বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। ৩০-৯০ সে. মি. উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এর পাতা পূরু সবুজ, লম্বা ও মোটা, যা গোড়া হতে অগ্রভাগ ক্রমশ: সরু হয়ে থাকে। পাতার নিচের অংশ বৃত্তাকার। পাতার অভ্যন্তরে পিচ্ছিল রাসালো পদার্থ থাকে যা স্বাদে তিক্ত। পাহতার দু-ধারেই করাতের মত কাঁটা থাকে। পাতার ভিতরের মাংশল অংশ পিচ্ছিল লালার মত। এর একটি উৎকট গন্ধও আছে এবং তার উপর তিক্ত স্বাদযুক্ত। এই গোত্রের অন্য একটি প্রজাতি আছে-নাম ঘৃতকাঞ্চন, বৈজ্ঞানিক নাম A. indica এবং ইরেজী নাম Indian Aloe, এটিকে অনেকে ঘৃতকুমারী বলে থাকেন। ঘৃতকুমারীর সাথে ঘৃতকাঞ্চনের পার্থক্য হল যে, ঘৃতকুমারীর পাতা আনারস গাছের মত গোড়ার দিকটা অপেক্ষাকৃত চওড়া ও এর কাটা অপেক্ষাকৃত গাঢ় সবুজ এবং গোড়ার দিকটা অপেক্ষাকৃত চওড়া ও এর কাটা অপেক্ষাকৃত ঘন। অপরপক্ষে ঘৃতকাঞ্চনের পাতা গোড়া থেকে বিপরীতমূখী হয়ে গজায় এবং রং অপেক্ষাকৃত হালকা সরু ও গোড়ার দিকটা অপেক্ষঅকৃত চওড়া কম। পাতার কাটার সংখ্যা তুলনামূলক কম। ঘৃতকাঞ্চনের পাতার অগ্রভাগ উপরের দিকে থাকে। ঘৃতকুমারী বড় আকারের হয়। এ গাছের পুষ্পদণ্ডটি সরু লাঠির মত হয়, ফুল লেবু রংয়ের, শীতের শেষে ফুল ও ফল হয়।

বিস্তৃতি : ঘৃতকুমারী বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায়। গাছটি দেখতে সুদৃশ্য বলে বনেদি বাড়ীর আশেপাশে খুব সহজেই এটির দেখা মেলে।

ব্যবহার্য অংশ : পাতার ভেতরের মজ্জা বা রসালো পিচ্ছিল পদার্থ।

চাষাবাদ বীজ বপণ ও রোপণ পদ্ধতি :

অংগজ প্রজনন পদ্ধতিতে এর বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। পার্শ্ব থেকে বের হওয়া ছোট ছোট অংগজ বংশ বিস্তারে সহায়তা করে। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে অযত্নে এই গাছটি জন্মে থাকে। কোন কোন স্থানে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ঘৃতকুমারী চাষ করা হচ্ছে। আবার অনেকে বাগান সাজানো কিংবা বাড়ীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য টবে এ গাছ লাগিয়ে থাকেন। এ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। এ কারনে উঁচু ভূমিতে এ গাছ লাগানো উচিত।

উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি : বাংলাদেশের আবহাওয়া ও সব ধরনের মাটিতেই ঘৃতকুমারী জন্মে থাকে। বন-জঙ্গল কিংবা, বাড়ীর আশেপাশেও জন্মে। তবে বেলে দোঁ-আশ মাটিতে উন্নতমানের ঘৃতকুমারী হয়ে থাকে।

সগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি : ঘৃতকুমারী পাতা সংগ্রহ করে পরিস্কার করে নিতে হয়। ধারালো ছুরি দিয়ে পাতার অভ্যন্তরীণ পিচ্ছিল মজ্জা পৃথক করা হয়। অনেকগুলো পাতার মজ্জা একত্রে পাত্রে নিয়ে মৃদু তাপে জ্বাল করা হলে যখন কিছুটা ঘনীভূত হয়ে আসবে, তখন চুলা হতে নামাতে হবে। এ ঘনীভূত নির্যাস রেক্সিন ছড়িয়ে দিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। জলীয় অংশটুকু শুকিয়ে শক্ত আকার ধারন করলে বায়ুরোধী পরিস্কার পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে একে মুছাব্বর বলে। তাছাড়া প্রসাধনী দ্রব্য তৈরীর ক্ষেত্রেও ঘৃতকুমারীর পিচ্ছিল মজ্জা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংরক্ষক (Preservative) নির্দিষ্ট মাত্রায় সংমিশ্রণ করতে হয়।

ঔষধি গুণাগুণ : কোষ্ঠকাঠিন্য, পরিপাকশক্তির দুর্বলতা ও বাত-ব্যাধিতে উপকারী। ইহা ত্বকের লাবন্যতা ও চুলের পুষ্টিকারক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্লীহা ও যকৃত প্রদাহ এবং ঋতুস্রাবের গোলযোগে অত্যন্ত কার্যকরী।

রাসায়নিক উপাদান : পাতার প্রধান রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে-এনথাকুইনোন গ্লাইকোসাইড যা অ্যালোইন, ইমোডিন, ক্রাইসোফ্যানিক এসিড, এলোইমোডিন, ইউরোনিক এসিড ও বিভিন্ন এনজাইম। এছাড়া, এতে রেজিন, স্টেরল ট্রাইটারপেনস, কুমারিনস, স্যাপোনিনস, কার্বোহাইড্রেটস, এমিনো এসিড ও ভিটামিন বিদ্যমান।

সাধারণ ব্যবহার : ঘৃতকুমারী লোকজ চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইউনানী-আয়ুর্বেদীয় ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রে ঘৃতকুমারী অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান। এছাড়া গৃহের শোভাবর্ধনে এবং প্রসাধন সামগ্রী প্রস্তুত করার জন্য প্রচুর পরিমাণ ঘৃতকুমারী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া, ত্বকের প্রসাধন দ্রব্য ও চুলের শ্যাম্পু তৈরীতেও ব্যবহৃত হয়।

বাজার চাহিদা : ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শিল্পে ঘৃতকুমারী পাতার অভ্যন্তরীণ মজ্জা ও মুছাব্বর একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসাবে প্রচুর পরিমানে ব্যবহার হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রসাধন সামগ্রী যেমন: বডি লোশন, সাবান, শ্যাম্পু, চুলের কলপ, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও ব্যাপক হারে ঘৃতকুমারী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন ভস্ম-কুশতা তৈরী করার ক্ষেত্রে ঘৃতকুমারীর অভ্যন্তরীণ মজ্জা বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব শিল্পে প্রতি বছর প্রায় ৩০০০ টনের অধিক ঘৃতকুমারী ব্যবহার হয়ে থাকে।

ঔষধি ব্যবহার :

ঔষধি হিসাবে এ গাছের পাতা, ডাটা ও মূলের ছাল ব্যবহৃত হয়। এর পাতার অভ্যন্তরস্থ শাঁস শুক্রবর্ধক ও বলকারক, হজমকারক। কোষ্টকাঠিন্যে বা কাঁশি হলে সারতে সহায়তা করে।

১) চোখের রোগে : চোখের রোগের ক্ষেত্রে এর পাতার রস বেশ উপকারী। প্রসাধন শিল্পে এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে।

২) পোড়া ঘাঁয়ে : যে কোন স্থান পুড়ে গেলে সাথে সাথেই যদি ঘৃতকুমারীর শাঁস প্রলেপের মতো দেওয়া যায়, তবে পোড়া ঘায়ে উপকার হয়।

৩) অগ্নিমান্দ্যে : ক্ষুধা লাগছে না, খেতে মন চাচ্ছে না, এক্ষেত্রে সকালে -বিকালে ৩ গ্রাম পরিমাণ ঘৃতকুমারীর শ্বাস একটু চিনি মিশিয়ে খেলে উপকার হয়।

৪) অর্শ রোগে: ঘৃত কুমারীর শ্বাস চা চামচের এক বা দেড় চামচ পরিমাণ, একটু খাটি গব্যঘৃত ঘি মিশিয়ে সকালে ও বিকেলে প্রতিদিন ২ বার খেতে হবে। (সাথে সাথে খাবার-দাবারসহ অন্যান্য নিয়মকানুন মানতে হবে।

৫) শিশুর মলরোধে: ১-৫ ফোঁটা পরিমাণ ঘৃতকুমারীর শ্বাসের রস একটু মধুসহ পান করাতে হবে।

৬) জন্ডিস কামলায় : ১ চা চামচ পরিমাণ শাঁস একটু মধু বা মিশ্রিসহ ২ বেলা খেতে হবে।

৭) প্লীহা ও যকৃত প্রদাহে : পাতার অভ্যন্তরে পিচ্ছিল মজ্জা ৭ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে দিনে ২ বার খালি পেটে পানিসহ সেব্য। নিয়মিত ১৫ দিন সেবন করলে উপকার পাওয়া যাবে।

৮) ক্রিমিতে : এক্ষেত্রে ঘৃতকুমারীর শাঁস ৫ গ্রাম করে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গুলিয়ে ২ বেলা খেতে হবে। তবে বেশিদিন খাওয়া যাবে না।

৯) ঋতুবন্ধে : ঘৃতকুমারীর শাঁস বের করে এনে ৫/৬টি স্তর দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে, সেই শুকনো ঘৃতকুমারীর (শাঁস) ২-৩ গ্রাম পরিমাণ গরম জলে ভিজিয়ে দিনে ২ বেলা খেতে হবে।

১০) মাসিকের ব্যথায় : মাসিক স্রাবের ১ম দিন থেকে ১ চামচ করে ঘৃতকুমারীর শাস প্রতিদিন খেতে হবে। এভাবে পরপর ৩ দিন। ৩ টি মাসিক স্রাব পর্যন্ত খেয়ে যেতে হবে।

১১) শ্বেত প্রদরে : -৩ চা চামচ ঘৃতকুমারীর রস + ১ চা চামচ মিশ্রি বা চিনি ১ গ্লাস ঠাণ্ডা পানিতে গুলিয়ে শরবত বানিয়ে প্রতিদিন। সকালে খেতে হবে। এভাবে ৭-১০ দিন।

১২) শুক্রবর্ধক : ঘৃতকুমারীর শাঁস ১ চা চামচ পরিমাণ একটু চিনি মিশিয়ে সকালে-বিকেলে ৬/৭ দিন খেলে উপকার পাওয়া যায়।

১৩) পেটে গ্যাস হলেও এই শাঁসের রস ২ বেলা খেতে হবে।

১৪) ঘৃতকুমারীর পাতার নির্যাস মাথায় ব্যবহার করলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে।

১৫) প্রস্রাবের সময় কোথ দিলে শুক্রস্থলন (শুক্রমেহ) হলে এবং ঠাণ্ডা জিনিসে আকর্ষণ বেশী দেখা দিলে, ঘৃতকুমারীর ৫ গ্রাম শাঁস এর সাথে একটু চিনি মিশিয়ে সরবত করে সকালে বা বিকালে ৬/৭ দিন খেলে ঐ ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।

১৬) কোন কোন মহিলার মাসের মধ্যে ২/৩ দিন স্তনে ব্যথা এমনকি কোমরও ব্যথা হয় অথচ ঋতু হয় না। এক্ষেত্রে ঘৃত কুমারীর শাঁস চটকে তরল করে আমসত্ত্বার মত রোদে শুকিয়ে এর ২/৩ গ্রাম গরম পানিতে ভিজিয়ে দিনে ২ বার করে খেলে মাসিক স্বাভাবিক হবে।

১৭) সদ্য প্রসূত শিশুর যদি এক মাসের মধ্যে পেট ফাঁপা, স্তন্যপানে অনিচ্ছা এর সঙ্গে কান্না থাকে, এক্ষেত্রে কোন প্রকার জোলাপ দেয়া সম্ভব নয়। তখন ঘৃতকুমারীর ১ ফোটা রস মধুর সাথে মিশিয়ে জিভে লাগিয়ে দিলে মলত্যাগ হবে এবং পেটের বায়ুও কমে যাবে।

১৮) ঘৃতকুমারী পাতার নির্যাস পানির সাথে মিশিয়ে পরিমিত পরিমাণে পান করলে হৃদযন্ত্রে ও স্নায়ুতন্ত্র সরল হয়, যৌন উদ্দীপনা বাড়ে, খাওয়ার রুচি আসে এবং বীর্য স্খলনের জ্বালা থাকে না।

১৯) ঠোঁটের কোণে কিংবা জিহ্বায় ঘা হলে পাতার দু’পাশের পাতলা স্তর ফেলে মুখের ভেতর রাখলে জিহ্বার ঘা সেরে যায়।

রাসায়নিক উপাদান: ‍a) Aloin, b) Isobarbaloin, c) Emodin, d) Crysophanic acid, e) Uronic acid, f) Gum, g) Resin, h) Glycosides

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *