তেঁতুল গাছ বা যমদুতিকা গাছ
প্রচলিত নাম : তেঁতুল, যমদুতিকা
ইংরেজী নাম : Tamarind
বৈজ্ঞানিক নাম : Tamarindus indica Linn
পরিবার : Leguminosae S.E. Caesalpinoideae
পরিচিতি : বৃহদাকার চিরহরিৎ বৃক্ষ। উচ্চতায় ২০-৩০ মিটার হয়। পাতা যৌগিক, পক্ষল ১২ সে. মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। পত্রক ১০-১৫ জোড়া ১২ সে. মি., লম্বাটে। বাকল বাদামী ও অমসৃণ ফাটলযুক্ত। ফুল লাল দাগসহ হলুদ বর্ণের গুচ্ছ। ফল পড ৭-১৫ সে. মি. লম্বা হয়। বাদামী খোসাবৃত থাকে, রস্যল ও টক।।
বিস্তৃতি : বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বত্রই তেঁতুল গাছ পাওয়া যায়। মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ মণ্ডলে এবং আবিসিনিয়া অঞ্চল তেঁতুলের আদি নিবাস। ভারতীয় উপমহাদেশে তেঁতুলের প্রবর্তন অনেক পুরোনো। সম্ভবত স্পেনিশ নাবিকদের মাধ্যমেহ । মোঘলদের আমল থেকে তেতুল ঘন-সবুজ ও ছায়ানিবিড় বৈশিষ্ট আদর্শ পথতরু। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা , পাকিস্তান, বার্মা, কম্পুচিয়া, থ্যাইল্যান্ড , মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে তেঁতুল গাছ দেখা যায়।
জাত : তেঁতুল গাছ একটি বৃহদাকার চিরহরিৎ বৃক্ষ। এর কাণ্ড সরল, নাতিদীর্ঘ, শাখায়িত। টক ও মিঠা এ দুরকমের জাত দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সবজাতই টক। কম্পুচিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে মিঠা তেঁতুলের চাষ হয়।
মাটি ও জলবায়ু : নিরীক্ষীয় অঞ্চলে তেঁতুল ভালো জন্মে। তেঁতুল একটি কষ্টসহিষ্ণু উদ্ভিদ। তাই অযত্নে রাস্তার পাশে, পোড়া জমিতে ও বনজঙ্গলে যে কোন ধরনের মাটিতেই জন্মাতে দেখা যায়। মাটি যে রকমই হোক না কেন পানি নিকাশের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
বীজ সংগ্রহ সময় : ফেব্রুয়ারী-মার্চ।
বীজের ওজন : প্রতি কেজিতে ৮০০-১০০০টি বীজ হয়।
বীজ আহরণ ও চারা উত্তোলন : এপ্রিল-জুন মাসে গাছে হলুদ বর্ণের লাল দাগসহ গুচ্ছ ফুল ফোটে। ফলের পড় ৭-১০ সে.মি. লম্বা ও ২৩ সে.মি. চওড়া এবং বাদামী খোসাবৃত। প্রতি ফলে ২-১২টি খয়েরী বা কালচে বর্ণের চকচকে বীজ থাকে। ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে ফল পাকে। প্রতি পডে ৪-৭টি বীজ থাকে। গাঢ় খয়েরী রংয়ের মোটা খােসাযুক্ত ফল সংগ্রহ করার পরই বীজতলায় বপন করতে হয়। বীজ বপনের ১০-১৫ দিনের মধ্যে চারা গজায়। বীজ ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর বপন করলে অংকুরোদগমের হার শতকরা ৭০-৮০ ভাগ পর্যন্ত হয়। চারা অবস্থায় তেঁতুল তাড়াতাড়ি বাড়ে, তবে একটু বড় হয়ে গেলে বৃদ্ধি কম হয়।
পলিব্যাগে বীজ বুনে একবছর পর অর্থাৎ বর্ষার প্রারম্ভে ৬০ ৬০ ৬০সে.মি. গর্ত করে গর্তের মাটির সাথে ২ ঝুড়ি পচা গোবর সার মিশিয়ে চারা লাগানো হয়। বাগান আকারে তেঁতুলের চাষ বাংলাদেশে হয় না বললেই চলে। তবে একের অধিক গাছ লাগালে ১২/১৪ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করা উচিত। সার প্রয়োগের কোন সুপারিশ নাই। বর্ষার আগে দুই/তিন ঝুড়ি পচা গোবর সার , ১.৫-২ কেজি ইউরিয়া , ৪০০-৫০০ গ্রাম করে টিএসপি ও মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগে ফলন ভালো হবে। সার প্রয়োগের ২ সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলে সেচ দিতে হবে। তেঁতুলে ছাঁটাই নিষ্প্রয়োজন।
ফল সংগ্রহ ও ফলন : বীজের গাছের ফল আসতে ৭/৮ বছর সময় লাগে। ছায়াময় স্থানে অবশ্য ফল আসতে একটু দেরি হতে পারে । ১২/১৩ বছর বয়স্ক গাছে ভালো ফলন হতে আরম্ভ করে। তেঁতুল সাধারণতঃ লম্বা বাঁশের সাথে তার বা নিড়ানি বেঁধে ২/৩ টি শুটি করে পাড়া হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে বছরে প্রায় আড়াই শত কেজি তেঁতুল সংগ্রহ করা চলে। বীজ আলাদা করে পাকা তেঁতুলের শাস হালকাভাবে সরিষার তেল মেখে রোদে শুকিয়ে এক বছরের অধিক গুদামজাত করে রাখা চলে।
তেঁতুলের কোন উল্লেখযোগ্য পোকা-মাকড় বা রোগের আক্রমণ নেই।
ঔষধি ব্যবহার :
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তেঁতুলকে বলা হয়েছে যমদূতিকা। আবার ভেষজবিদগণ একে অভিহিত করেছেন প্রাণদায়িনী ও শক্তিধারিণী হিসেবে। রোগ প্রতিকারে তেঁতুলের ব্যবহার অনেক।
১) তেঁতুলের আধুনিক ব্যবহার হচ্ছে রক্তে কোলস্টেরল এর মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে। তেঁতুল যে কোলস্টেরল কমায় তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত তেঁতুল খায় তাদের রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা একেবারেই কম।
২) ভেষজবিদগণের মতে, নিয়মিত তেঁতুল খেলে শরীরে সহজে মেদ জমে না।
৩) বাতের ব্যথায় যারা কষ্ঠ পান তাদের জন্য তেঁতুল পাতা খুবই ভালো ওষুধ, বিশেষ করে পূর্ণিমা বা আমাবস্যায় যাদের পায়ের হাঁটু কিংবা হাতের জোড়া ফুলে ওঠে, তাদের বেলায় তেঁতুল সেদ্ধ বেটে অল্প গরম করে ফোলা কিংবা ব্যথার স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা কমে যায়।
৪) তেঁতুল পাতা সেদ্ধ পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধুলে তাড়াতাড়ি সেরে যায়। মুখের ভিতর ক্ষত হলে তেঁতুল-সেদ্ধ পানি মুখে নিয়ে অন্তত ৫ মিনিট রেখে দিতে হবে। এভাবে দুই/তিন দিন করলে মুখের ক্ষত সেরে যায়।
৫) তেঁতুলের পাতা পিষে অল্প সোরা (বাজি তৈরীর উপকরণ) মিশিয়ে সাধ্যমত গরম করে লাগালে ব্যথা ও ফোলা দুই এক দিনের মধ্যে কমে যাবে।
৬) পিত্ত বিকারের কারণে অনেকেই প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়ায় ভোগেন। এক্ষেত্রে এক চা চামচ পরিমাণ তেঁতুল পাতার রসের সরবত খেলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া থাকেনা।
৭) অর্শ রোগে আক্রান্ত হয়ে যাদের শরীর থেকে রক্ত বের হয়, তারা পুরনো তেঁতুল সেদ্ধ পানি খেতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের উপশম হয়।
৮) সর্দি হলে কচি তেঁতুল পাতা সেদ্ধ রস কড়াইতে সরিষার ফোড়ন দিয়ে খেলে সর্দির উপশম হয়। বুকে সর্দি বসে গিয়ে যখন খুব কষ্ট হয়, তখন পুরানো তেঁতুল ভিজানো পানি খেলে সর্দি বেরিয়ে যাবে। সর্দি-গর্মিতে হাত-পা অবশ হয়ে পড়েছে বলে মনে হলে, সেক্ষেত্রে কাঁচা তেঁতুল পুড়িয়ে বা পুরাতন তেঁতুলের সরবত বানিয়ে খেলে এ অসুবিধা কমে যাবে। এতে লবন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
রাসায়নিক উপদান : টেমারিক এসিড (Tamaric acid), মেলিক এসিড (Malic acid), অক্সালিক এসিড (Oxalic acid) ও পলিসেকারাইড (Polysaccharide) ইত্যাদি।
সাধারণ ব্যবহার : কাঠ খুবই শক্ত, ভারী, দৃঢ় টেকসই এবং সহসা পোকা ধরে না। কাঠ দেখতে রক্তাক্ত বাদামী বর্ণের। গরুর গাড়ীর চাকা, পেঁকি, ঘানি, আসবাবপত্র বানাতে ব্যবহৃত হয়। তেঁতুল অতি উত্তম জ্বালানী কাঠ এবং ইটের ভাটায় বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। তেঁতুলের পাতা থেকে হলুদ রং পাওয়া যায়। বাকলের ট্যানিন চামড়া ট্যান করতে এবং কাঠের গুঁড়া দিয়ে চামড়া অপসারণ করতে হয়। তেঁতুল বীজ গরম পানিতে উত্তপ্ত করে একপ্রকার গাম/আঠা তৈরী করা হয় এবং উহা পেইন্টিং কাজে ব্যবহৃত হয়। তেঁতুলের মণ্ড টক এবং উহা ওষুধ, খাদ্য ও ধাতব পাত্র পরিস্কারে ব্যবহৃত হয়।