নারিকেল গাছ
প্রচলিত নাম : নরিকেল
ইংরেজী নাম : Coconut
বৈজ্ঞানিক নাম : Cocos nucifera Linn.
পরিবার : Palmae
পরিচিতি : শাখা-প্রশাখাবিহীন এক বীজপত্রী চিরসবুজ বড় আকারের বৃক্ষ। উচ্চতায় ১৫-৩০ মিটার পর্যন্ত হয়। পাতা যৌগিক লম্বায় ৪৬ মিটার পর্যন্ত হয়। প্রতিটি পত্র ফলক প্রায় ১ মিটার প্রশস্ত। কাণ্ডের অগ্রভাগে মুকুটের আকারে সাজানো। একটি গাছে পুরুষ ও স্ত্রীফুল আলাদাভাবে জন্মে। ফুল সবুজাভ হলুদ। শিকড় গুচ্ছ মূল। নারিকেলের ফল ড্রোপ ।
বিস্তৃতি : প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ এলাকা নারিকেলের জন্মভুমি। নারিকেল গাছ শ্রীলংকা , ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপিনস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ওশেনিয়া, আফ্রিকা , মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশী জমেন্ম। পরিমিত ক্ষারত্ব অম্লত্ব, ও লবনাক্ততাসহিষ্ণু এই গাছটি উপকুলীয় বালুময় অঞ্চল থেকে ৬০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চ পাহাড়ী উর্বর ভূমিতে জলাতে পারে। পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত দো-আঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি নারিকেল চাষের জন্য খুব উপযোগী। নারিকেল পামেসী পরিবারভুক্ত, শাখা-প্রশাখাবিহীন এব বীজপত্রী চিরসবুজ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আর্দ্র ও নোনা মাটিতে নারিকেল গাছ ভাল জন্মে। নারিকেল বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশী জন্মে। তবে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী, যশোহর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে পচুর নারিকেল জন্মে। নোহনা বা উপকুলীয় এলাকায় নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় বিধায় মাটিতে রসের অভাব হয় না এবং বাতাসে আর্দ্রতা বেশী বিধায় ফলন ভাল হয়।
নারিকেলের জাত : বাংলাদেশে একাধিক জাতের নারিকেল চাষ হয়। এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
১. বেটে জাত: ৪-৫ বৎসরের মধ্যে ফল হয় যেমন: ফুমিলা, গংগা, বন্দম, চৌঘাট, ডোয়ার্ক, হরিপদুয়া, পিলিপোগ ইত্যাদি।
উচ্চতায় ১৫ মিটারের বেশী হয় না এবং ৪০-৫০ বছরের বেশী বাচে না।
২. লম্বা জাত: ৭-১০ বছরের মধ্যে ফল হয় এবং ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত ফল ধরে। গাছ খুব উচু হয়। যেমন: কলম্বো , কামানডালা, কাপ্পাদম, আন্দামান, জয়েন্ট, রেনেল টল প্রভৃতি এ জাতের গাছ ৭০-৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
ফলন : বাংলাদেশে যেসব নারিকেল গাছ দেখা যায় তার অধিকাংশ লম্বা জাতের। গাছপ্রতি গড় বাৎসরিক উৎপাদন মাত্র ২৫টি নারিকেল। বাংলাদেশে গ্রীন নামক নতুন উদ্ভাবিত দেশী লম্বা জাতের নারিকেল গাছের ফলন বেশী। গাছ প্রতি বছরে ৫০-৮৫ টি নারিকেল ফলে।
বংশ বিস্তার : বীজ থেকে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে নারিকেলের বংশ বিস্তার হয়। ভাল চারার জন্য ভাল মা-গাছ ও ভাল বীজ অপরিহার্য। প্রতিকূল আবহাওয়ায় যে গাছ বছরে ৬০টিরও বেশী মধ্যম থেকে বড় আকারের গোলাকৃতির ফল দেয় এমন মধ্যবয়সী (২০-৫০) বছর গাছ থেকে নারিকেল বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। নির্বাচিত গাছটি অবশ্যই সুস্থ, সবল,ঘন পাতাবিশিষ্ট, ফলের বোটা খাটো, নোটা ও শক্ত হওয়া দরকার।
বীজ নারিকেলের জন্য ”মা”-গাছ নির্বাচন :
বীজ নারিকেল সংগ্রহের পূর্বে ”মা”-গাছ নির্বাচন করতে হবে । ”মা”-গাছের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ হতে হবে :
- নারিকেল বাগানে বীজ মাতা নির্বাচন করা উত্তম।
- গাছের বয়স ২০-৫০ বৎসর হতে হবে।
- কাণ্ড সোজা ও মজবুত হতে হবে এবং ন্যূনতম ৩০টি পাতা থাকবে। কাদিতে প্রচুর সংখ্যক ফল থাকতে হবে।
- ১০০টির অধিক ফল দিতে সক্ষম গাছ হলে উত্তম।
বীজ সংগ্রহ : আগস্ট- অক্টোবর।
বীজ নির্বাচন :
১) বীজ ভাল ও উন্নতমানের হতে হবে।
২) বীজটি গোলাকার ও বড় আকার হওয়া চাই।
৩) বীজের বয়স ১১-১২ মাস হতে হবে এবং জুন -সেপ্টেম্বর মাসে বীজ সংগ্রহ করা হয়।
৪) বীজ সুপরিপক্ক ও ওজনে ভারী হতে হবে।
৫) বীজ আঘাতমুক্ত ও ক্ষতহীন হতে হবে।
৬) বীজের ওজন প্রায় ২ কেটি, মাঝের বেড় প্রায় ৫৫-৬০ সে.মি. হলে ভাল হয়।
৭) বীজ নোটা ও শক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়।
৮) বীজের খোসা পাতলা ও শাস পুরু হতে হবে ।
৯) বীজের মধ্যে প্রচুর পানি থাকতে হবে।
১০) বীজ রোগ ও কীটমুক্ত থাকতে তবে।
১১) বীজ অবশ্যই ভারী হতে হবে। পানিতে ডুবালে বোঁটার দিক উপরের দিকে থাকবে। পাতলা ফলের বেলায় ফলের দীর্ঘ অক্ষ পানির সমান্তরালভাবে ভাসতে থাকে।
১২) গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের ২-৩ মাসের মধ্যে বপন করা বাঞ্চনীয়।
নারিকেল নার্সারী উত্তোলন :
নারিকেল নার্সারী বেডে রোপণ করা হয়। নার্সারীতে চারা উত্তোলনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১. ১. বীজ পরিশোধন: নার্সারী বেডে বীজ লাগানোর আগে সংগৃহীত বীজ চটের বস্তায় ভরে ৫-৭ দিন পানির নীচে ডুবিয়ে অন্ধকার বন্ধ ঘরে স্তুপাকার রেখে ভিজা বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখলে ১-২ মপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ ভাল বীজ অংকুরিত হয় বলে জানা যায় । পানিতে অতিরিক্ত বেশীদিন ডুবানো ক্ষতিকর হতে পারে। বীজ সংগ্রহের পর বেশীদিন গুদামজাত করে রাখলে বীজের ক্ষতি হয়। সংগ্রহের ৪২ দিনের মধ্যে বীজতলায় লাগালে বীজের অংকুরোদগম হার বেশী হয়।
২. বীজতলা: নারিকেলের বীজতলার জন্য রেটরইটিক মাটির চেয়ে বেলে মাটি ও বেলে দোআঁশ মাটি বেশী উপযোগী। বীজ বপনের পুর্বে নার্সারীতে মাটি তিন দফায় কমপক্ষে ৩০ সে.মি. গভীরতায় ভালভাবে কুপিয়ে মাটি খুঁড়ো করে ১২মি.১.২মি. (৪০’৪’) আকারের বেড তৈরী করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য প্রতিটি বেড মাটির সমতল থেকে ২৫ সে.মি. উঁচু হওয়া আবশ্যক। প্রতি বেডে ০.৫৬৬ ঘন মিটার (২০০ ঘনফুট) গোবর ও কম্পোস্ট ০.১৪১ ঘন মিটার (৫.০ ঘনফুট) ছাই, ১.৫০ কেজি টি এসপি ও ১.০০ কেজি এম পি সার ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। মাটিতে উইপোকার আক্রমণ থাকলে হেক্টরপ্রতি ১১২ কেজি ডাইয়ালড্রিন ২% ডাস্ট মাটির উপরের ৮ সে.মি. স্তরে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বিএইচসি ১০% ডাস্ট হেক্টর প্রতি ৫৬ কেজি হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ইহা ছাড়াও হেপ্টাক্লোর উইপোকা দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বালুমাটিতে উইপোকার আক্রমণ হয় না বলে উক্ত মাটি নারিকেল নার্সারীর জন্য উত্তম। নারিকেল বেডে ছত্রাকের আক্রমণ বেশী হয় বলে বীজ বপনের পুর্বে বোর্দেমিক্সার, বর্গান্ডিমিক্সার, কুপ্রাভিট, ডায়থেন-এম-৪৫ জাতীয় ছত্রাকনাশক দ্বারা মাটি শোধন করে নিতে হবে ।
৩. বীজ বপন : সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বেডে নারিকেল রোপণের পূর্বে একটি একটি করে নারিকেল বড় বালতি/ড্রামের পানিতে ভাসিয়ে বীজ বপনের প্রাকৃতিক দিক ঠিক করে উপরের দিকে রং দ্বারা দাগ দিতে হবে এবং সে অনুসারে বেডে স্থাপন করতে হবে। বীজ বপনের পুর্বে প্রতি বেডে ১৫ সে.মি. চওড়া ও ১ সে.মি. গভীর করে বেডে লম্বালম্বিভাবে এবং সারি থেকে সারির দূরত্বে ১০ সে.মি. রেখে ৫টি ট্রেঞ্চ করে নিতে হবে। উক্ত ট্রেঞ্চে নারিকেল বীজ আড়াআড়িভাবে অথবা ২৫-৪৫’ কোণের বোঁটার দিকে উপরের দিকে রেখে এমনভাবে বপন করতে হবে যেন এক নারিকেলের কেন্দ্র থেকে আর এক নারিকেলের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব ২০ সে.মি. হয়। বেডে বীজ বসানোর আগে বীজের মুখের খোসাটি সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন। আড়াআড়ি বা পার্শ্বভাবে বীজ বসানো হলে বীজের চওড়াভাগ উপরের দিকে রাখতে হবে। বীজ বসানোর পর সম্পূর্ণ বীজ আলগা মাটি দিয়ে না ঢেকে সামান্য খোলা রাখা দরকার। ৪০’৪’ সাইজের একটি রেডে ১০” ‘ ১০” দূরত্বে ২৪০-২৬০টি নারিকেল লাগানো যায়। বেডে নারিকেল রোপণের পর আগা মাটি দ্বারা ঢেকে দিতে হবে যাতে মুখের /বোটার অংশ বাদ থাকে।
৪. ছায়া প্রদান : ভাল চারার জন্য নার্সারীতে প্রচুর আলো-বাতাস থাকা অত্যন্ত জরুরী। তবে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রৌদ্রের সময় (ফ্রেরুয়ারী মে মাসে) ধইঞ্চার হাল্কা ছায়া দেওয়া যেতে পারে।
৫. মালচিং ও পানি সেচ : নার্সারীতে গ্রীষ্মকালে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হয়। মাটির আর্দ্রতা ও পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখার জন্য কচুরিপানা বা খড় দিয়ে প্রতিটি বেড ভালভাবে মালচিং করা দরকার । বীজ বসানোর ১৬ সপ্তাহের মধ্যে চারা গজালে সে বীজ বাতিল করতে হবে।
৬. কীটনাশক ঔষধ ও সার প্রয়োগ : চারা গজানোর পর প্রয়োজন অনুসারে ছত্রাকের ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। চারা ০.৩ মি. লম্বা হাল্কা ডোজে পানির সাথে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায় তাতে চারার বৃদ্ধি ভাল হয়। চারা গজানোর পর পরিমিত পটাশ সার দিলে চারা সতেজ ও সবল হয় । বেডের মাটি শক্ত হয়ে গেলে নিড়ানী দ্বারা হালকাভাবে মাটি আলগা করে নিতে হবে। চারা এক বছর পর যখন ১-১.৫ মি. অধিক লম্বা হয় তখন বাগানে লাগানো যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ২ বছর বয়সের ১.৫-২.০ মি. লম্বা চারা বাগানে লাগানো হয় এবং এতে ভাল ফল পাওয়া যায়।
নারিকেল বাগান সৃজন :
নারিকেল বাগানে সুপারি বাগানের মতো ৪ (চার) পদ্ধতিতে সৃজন করা হয়। যেমন :
- বসতবাড়ীতে চারিদিকে সীমানায় সারিবদ্ধভাবে।
- বসতবাড়ীতে এলোপাথাড়িভাবে।
- জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাইন করে বাগান সৃজন।
- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অঙ্গনে শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ হিসেবে।
নারিকেল বাগান সৃজন পদ্ধতির পর্যায়সমূহ নিম্নরূপ :
১. রোপণের জন্য চারা নির্বাচন : বেডে বপনকৃত বীজ থেকে আগে গজানো দ্রুত বর্ধনশীল সতেজ ও সবল পোকা-মাকড় ও রোগবালাইমুক্ত ৭-৮ মাস বয়সী চারা রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
২. চারা উঠানো : চারা ডগা ও বোটা টেনে নার্সারী থেকে চারা উঠানো উচিত নয়। কোদাল বা শাবল দিয়ে চারার চারপাশ খুঁড়ে চারা উঠানো ভাল।
৩. রোপণের জন্য গর্তে খনন: প্রস্তাবিত বাগান এলাকায় এপ্রিল মাসে ৭, ৮ বা ৯ মি. দূরত্বে গর্ত করতে হবে। চারা রোপণের জন্য কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে সর্বনিম্ন ০.৭৫ মি ০.৭৫ ০.৬০ মিটার মাপের গর্ত খনন করতে হয়। শুকনো লতাপাতা , খড়কুটা, নারিকেল ছোবড়া , তুষ ইত্যাদি গর্তে পোড়ানো খুবই ভাল। ইহাতে গর্তের মাটি যেমন পরিশোধিত হয় তেমনি মাটি এক পার্শ্বে ও নীচের অংশের মাটি অন্য পার্শ্বে রাখা প্রয়োজন। গর্ত ভরাটের পূর্বে গর্ত প্রতি ২০ কেজি পচা গোবর সার, ৫ বেজি ছাই, ৩০০ গ্রাম এমটি ও ৫০০ গ্রাম টি, এস, পি সার, খৈল ১.০ কেজি ও লবণ ১ কেজি উপরোক্ত মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে উপরের অংশের মটি নীচে এবং নীচের অংশের মাটি উপরে দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। সারযুক্ত মাটি দ্বারা গর্ত ভরাটের ৭-১০ দিন পরে চারা লাগান উত্তম।
৪. চারা রোপণ : বীজতলা থেকে চারা উঠানোর সাথে সাথে চারা রোপণ উত্তম। রোপণের জন্য ৭-৮ মাস সয়সী চারা উৎকৃষ্ঠ । বর্ষার প্রারম্ভে মে-জুন মাসে (বৈশাখ-আষাঢ়) ৭, ৮ ও ৯ মিটার দূরত্বে সরিতে বিংবা গ্রুপে চারা রোপণ করা যেতে পারে। এক সারিতে কিংবা গ্রুপ লাগানোর ক্ষেত্রে চারা রোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে নারিকেলটি যেন সম্পূর্ণ মাটির নীচে চলে যায় এবং চারাটি যেন ২০ সে.মি. ৩০সে.মি. গর্তের গভীরে রোপিত হয়। এতে গাছ বড় হলে শিকড় উপরে ভেসে উঠবে না। রোপণকালে আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নারিকেলের পিঠের কিছু অংশ উপরে দৃশ্যমান থাকে এবং চারার গোড়াটি (কলার) যেন মাটিতে ঢাকা না পড়ে অর্থাৎ বীজের অংশ অনাবৃত থাকবে।
৫. সার প্রয়োগ : মাটি উর্বর হলে গাছ লাগানোর প্রথম বছর মাটিতে সার দেওয়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না। মাটি উর্বর না হলে চারা রোপণের ৬ মাস পর গাছপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। চারা রোপণের ২ বছর থেকে গাছে ফুল আসা পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত মিশ্র সার বর্ণিত হারে ও নিয়মে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। চারা রোপণের পরবর্তী পর্যায়ে নিম্নবর্ণিত সারের মিশ্রণে নিম্নহার ব্যবহার করা যেতে পারে :
সার পরিমাণ
ইউরিয়া ৭ ভাগ।
টি.এস.পি – ৭ ভাগ
এম. পি – ৮ ভাগ
প্রতি কেজি ইউরিয়ার পরিবর্তে ৪০/৫০ কেজি পচা গোবর এবং প্রতি কেজি এম পি সারের পরিবর্তে ১০/১৫ কেজি ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. সার প্রয়োগ পদ্ধতি: ২ বছর থেকে ৪ বছর বয়সী চারার গোড়া থেকে ৩০সে.মি. দূরে দুই পাশে সার প্রয়োগ করতে হবে। চারার গুড়ি তৈরী হওয়ার পর চারার গোড়া থেকে ৬০ সে.মি. দুরে ৬০ সেমি চওড়া গোলাকার ট্রেঞ্চ করে সার প্রয়োগ করতে হবে। আবার ফুলন্ত ও ফল আসার সময় গাছের গোড়া থেকে ৯০ সে.মি. দুরে ৯০ সে.মি. চওড়া ১৫ সে.মি. গভীর ট্রেঞ্চ করে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর মাটি দিয়ে পুনরায় ট্রেঞ্চ ভরাট করে দিতে হবে।
৭. পরিচর্যা : চারা লাগানোর এক বছর পর কোন কোন চারা যদি ঠিকমত না বাড়ে তাহলে সেই চারা ফেলে দিয়ে তার পরিবর্তে নতুন সুস্থ, সবল চারা লাগাতে হবে। নারিকেল পাতা না শুকানো পর্যন্ত কাটা উচিত নয়। শুকনো মৌসুমে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর পানি সেচ দেওয়া প্রয়োজন। রোগের আক্রমণ অথবা পটাশ সারের অভাব ঘটলে নারিকেল গাছেরফুল ঝরার সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিচর্যাকরণে সমস্যা এড়ানো যায়। বছরে কমপক্ষে ২ বার গাছের মাথার অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা ও শুকনো পাতা পরিস্কার করতে হবে। নারিকেল গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত ফাঁকে অন্য ফসল করা যেতে পারে।
ফল সংগ্রহ ও ফলন :
ফল ভালভাবে ঝুনো হলে তবেই পাড়া উচিত। ফুল আসার ও ফল ধরার পর এ রকম ঝুনো হতে প্রায় ১ বছর সময় লেগে যায়। ঝুনো হলে কাদি কেটে, দড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে কাদি নামানই ভাল।
প্রতিবছর প্রতিটি পরিণত গাছ হতে কমপক্ষে ৪০-৫০টি নারকেল পাওয়া যায়, তবে’হাজারী ইত্যাদি জাতের গাছ থেকে অনেক বেশী নারকেল পাওয়া যায়। একরে প্রায়, গাছের চেহারা অনুযায়ী, ২,৫০০-৪,০০০ ফল পাওয়া যায়। এর থেকে বছরে খরচ বাদ দিয়ে ১৫,০০০ টাকা লাভ হতে পারে।
চারার বয়স | প্রয়োগ কাল ও সারের পরিমাণ | চারা প্রতি সর্বমোট সার | |
বছর | বর্ষার পূর্বে | বর্ষার পরে | চারা/কেজি |
২য় বছর
৩য় বছর ৪র্থ বছর ৫ম বছর
|
৪৫০ গ্রাম
৫০০ গ্রাম ৫০০ গ্রাম ৬২৫ গ্রাম
|
৪৫০ গ্রাম
৫০০ গ্রাম ৫০০ গ্রাম ৬২৫ গ্রাম
|
৯০০ গ্রাম
১০০০ গ্রাম ১০০০ গ্রাম ১২৫০ গ্রাম
|
চারার স্টেম বা গুড়ি না হওয়া পর্যন্ত চারা প্রতি অতিরিক্ত ০.৪৫০.৯০ কেজি ফসফেট ও ০.৪৫ কেজি এমপি সার প্রয়োগ করা ভাল। ফলন্ত গাছে নিম্নবর্ণিত সারের মিশ্রণ গাছ প্রতি ৪ কেজি হারে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
সার পরিমাণ
ইউরিয়া ৭ ভাগ।
টি.এস.পি – ৭ ভাগ
এম. পি – ৮ ভাগ
সাধারণ ব্যবহার : নারিকেল কচি অবস্থায় ডাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কচি ডাবের খোসা ছাগলের ভাল খাদ্য। পাকা নারিকেলে শাসে ৩০-৪০% তৈল পাওয়া যায় এবং নারিকেল তেল মাথায় ও খাদ্য হিসেবে তরকারীতে ব্যবহৃত হয়। শুকনো নারিকেলের ছোবড়া হতে দড়ি, কুশন, জাজিম ও পাপোষ ইত্যাদি তৈরী হয়। নারিকেল পাতা ঘরের ছাউনীতে, মাদুর, ঝুড়ি তৈরীতে এবং পাতার মধ্যশিরা দিয়ে ঝাড় তৈরী হয়। গাছের ফুলের ডাটা থেকে সুমিষ্ট রস সংগ্রহ হয়। নারিকেলের খোল থেকে জ্বালানী ও কাঠ কয়লা তৈরী হয়। কাণ্ড সরল সোজা বিধায় বৈদ্যুতিক খুঁটি, বেড়ার খুঁটি, ঘরের খুঁটি, হাঁটার ছড়ি, টার্নেরী, বর্শার হাতল, কারুকাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে কান্ড চিড়িয়ে আদল রোয় তৈরী করা হয়। নারিকেলের মালা কুটির শিল্পের কাজে ও হুক্কাতে ব্যবহৃত হয়। মালা পোড়ানো ছাই কালো ব্ল্যাকবোর্ড আস্তরণে ব্যবহৃত হয়।
ঔষধি ব্যবহার :
১) গ্রন্থি মলে : মল নিঃসরণ হচ্ছে বটে, তবে তা নিরবচ্ছিন্নতা থাকছে না, অর্থাৎ একটা বুলেট বেরিয়ে গেল, আবার একটা এলো, তার উপর এর গায়ে পাকা আম জড়ানো এ রকম ক্ষেত্রে সেখানে প্রত্যহ ঝুনো নারিকেল মিহি করে কুরে অথবা ঐ কোরা নারকেল অল্প জলে গুলে ন্যাকড়ায় হেঁকে দুধটা খেতে হবে, আধখানা অর্থাৎ একমালা নারিকেল হলেই চলবে তবে ৪/৫ দিন প্রত্যহ খেতে হবে এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
২) মুত্রকৃচ্চতায় : অজীর্ণজনিত কারণে, অত্যধিক রৌদ্রে ঘোরায় অত্যধিক পরিশ্রমে অথবা একনাগড়ে এক আসনে চেপে বসে থাকায় যে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা আসে, সেক্ষেত্রে একটা বা দুটো কচি ডাবের জল খেলে সাময়িক ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।
৩) কোষ্ঠবদ্ধতায় : পিত্ত শ্লেষ্মার ধাতু বায়ুর জন্য দাস্ত পরিস্কার হয় না। এক্ষেত্রে ঝুনো নারকেলের জল প্রত্যহ খালি পেটে এক বা দুই কাপ করে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে ।
৪) প্রোস্টেট গ্রন্থির স্ফীতিতে : প্রস্রাব লাগলে ধরে রাখার ক্ষমতাও অনেকের থাকে না, আবার কারও কারও লাগলেও একসঙ্গে বেরোয় না, ফোটা ফোটা ঝরতে থাকে, এক্ষেত্রে নারিকেল গাছের কাঁচা শিকড় ঘেঁচে রস করে সকালের দিকে এক চা-চামচ ও বিকালের দিকে এক চা-চামচ একটু দুধ মিশিয়ে খেলে ৭/৮ দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য উপকার পাওয়া যায় ।
৫) ফিতে ক্রিমিতে : এটা অবশ্য পশুর পেটেই বেশ হয় সত্যি, কিন্তু মানুষের পেটেও হয়। এক্ষেত্রে শুষ্ক নারিকেল (এগুলি মেওয়ার দোকানে পাওয়া যায়) যতটা, তার সিকিভাগ সৈন্ধব লবন মিশিয়ে থেঁতো করে রাখতে হবে, সেই চূর্ণ সকালের দিকে খালি পেটে ২ গ্রাম মাত্রায় ও বিকালের দিকে ২ গ্রাম মাত্রায় জলসহ কিছুদিন খেতে হবে। কিছুদিন খেলে ঐ ক্রিমি টুকরো টুকরো হয়ে মলত্যাগের সময় মনের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।
৬) অজীর্ণ রোগে : অবশ্য যদি এটা সাময়িক হয়ে থাকে তবে ঝুনো নারিকেল বেটে জলে গুলে ঘেঁকে নিয়ে, সেই জল পাক করে টাটকা তেল করে নিতে হবে, সেই তেল ১চা-চামচ ভাত খাওয়ার সময় প্রথমেই ভাতে মেখে নিতে হবে, ২/৪ দিন খেলেই এই সাময়িক অজীর্ণটা সেরে যাবে।
৭) অম্লপিত্ত রোগে : যদিও এ রোগে চিকিৎসক ঘি ও চিনি খেতে দিতে চান না, তবুও লিখি: ঝুনো নারিকেল কুরে সেটাকে ঘিয়ে ভেজে আন্দাজ ১০ গ্রাম করে দু’বেলা খেতে হবে। এটা তৈরী করতে গেলে ২ চা-চামচ ভাল ঘি কড়াইয়ে চড়িয়ে নিম্ফেন হলে ১ চা-চামচ চিনি দিয়ে ভেজে নিতে হবে, তারপর ২০ গ্রাম আন্দাজ নারিকেল কোরা ঐ সঙ্গে ভেজে সকালের দিকে অর্ধেকটা ও বিকালের দিকে অর্ধেকটা খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ রোগের উপকার ও উপশম হবে।