গাছপালা

পেয়ারা গাছ

প্রচলিত নাম : গয়া, গুয়ুম

ইংরেজী নাম : Guava

বৈজ্ঞানিক নাম : Psidium guajava (Linn.) Bat.

পরিবার : Myrtaceae

পরিচিতি : পেয়ারা ছোট আকারের চিরসবুজ গাছ। উচ্চতা ৫-১০ মিটার পর্যন্ত। পেয়ারা বাংলাদেশের ফল না হলেও এদেশের ফলের বাজারে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে। দামের দিক থেকেও এই ফলটি চাষ করা লাভজনক। পছন্দের নমুনা হিসাবে হয়তা সবার বাড়ীতেই দু’একটা পেয়ারা গাছ দেখা যায়। ফলটির বৈশিষ্ট্য স্বাদে কষায় মধুর, ভিটামিন সি ও শর্করা বিশেষতঃ পেকিটিনে পরিপূর্ণ। পেয়ারাকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আপেল বলা যায়।

বিস্তৃতি : দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উষ্ণঞ্চলে পেয়ারার জন্মস্থান। এর অন্যান্য গোত্র প্রধানতঃ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের উষ্ণ অঞ্চলে দেখা গেলেও একমাত্র সহগোত্র, লবঙ্গ এশিয়া মহাদেশের মালাক্কাতে উদ্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য জাতের পেয়ারা রয়েছে। কিন্তু এগুলো থেকে উৎকৃষ্ট জাতের শনাক্ত ও নামকরণের উপযুক্ত পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট জাতের মধ্যে রয়েছে বরিশালের স্বরূপকাঠি (গাছ মাঝারি আকৃতির ফল উপবৃত্তাকার সুমিষ্ট ও সুগন্ধযুক্ত) চট্টগ্রামের কাঞ্চন নগর (নশপাতি আকারে শাঁস সুস্বাদু ও পুরু, বীজের সংখ্যা কম); কাজী পেয়ারা (গাছ ৪.৬-৫৫ মিটার উঁচু ফল বড় ৫০০-৭০০ গ্রামের মতো, উপ-বৃত্তাকার, শাঁস অম্লমধুর ও মুখরোচক)। থাইল্যান্ড থেকে আনীত এই জাতটি আমাদের সাথে আপন হয়ে রয়েছে।

মাটি ও জলবায়ু : পেয়ারা গাছ বেশ সহনশীল। মোটামুটি সব রকম জলহাওয়ার সাথেই মানিয়ে নিতে পারে। কাঁকুড়ে, ল্যাটারাইট, বেলে দো-আঁশ, কাদা ও এঁটেল ও যে কোন মাটিতেই পেয়ারার চাষ হতে পারে। এর কারণ, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মূলের গভীরতার তারতম্য ঘটে। কাকুড়ে বা ল্যাটারাইট মাটিতে শিকড় বেশী গভীরে যায় না। আবার বেলে-দোআঁশ মাটিতে শিকড় গভীরে যেতে পারে। মাত্র ৪৬ সে.মি. গভীর মাটিতেও ভাল পেয়ারা গাছ জন্মাতে দেখা যায়। পৃথিবীর বহু জায়গায় জংলী গাছ হিসাবে জঙ্গলে ও পাহাড়ের ঢালে পেয়ারা গাছ জন্মায়। গাছটি কিছুটা চরম জলহাওয়াতেও ভাল হতে দেখা যায়।

চারা তৈরী : পেয়ারা গাছ বীজ থেকে উৎপন্ন হলেও, বীজের গাছগুলো লিকলিকে রোগা হয় ও ফল আসতে দেরি হয়। তাছাড়া ইতর পরাগ সংযোগে উৎপন্ন হওয়ায় চারার প্রকরণ, মূল গাছের সাথে মেলে না। এজন্যই নানা ধরনের কলম করার পদ্ধতিও প্রচলিত আছে। বীজতলা তৈরী করে পেয়ারা বীজ ১৫ সে.মি. অন্তর ১২ সে.মি. মাটির গভীরে সারি করে লাগান হয়। সারি থেকে সারিতে দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি. দেওয়া হয়। বর্ষার আগে বীজ বপন করলে, এক বছরের মধ্যে চারা তৈরী হয়ে যায় ও মূল জমিতে রোপণ করা সম্ভব হয়। এক বছর বয়সী চারার সাথে জোড় কলমও করা যায়। সেজন্য চারাগাছটিকে বীজতলা থেকে তুলে একটি মাটির বা পলিথিনের পটে রোপণ করতে হবে। পরে মূলগাছের সঙ্গে জোড়াকলম বাঁধতে হবে। ভারতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও এলাহাবাদ কৃষি মহাবিদ্যালয়ে ২-৩% ন্যাপথলিন এ্যাসিটিক আসিড বা ইনডোল বিউটিরিক অ্যাসিড জাতীয় হর্মোন প্রয়োগ করেও পেয়ারাতে গুটিকলম ও শাখা কলম করা হচ্ছে। পেয়ারার চোখ কলম করা যায়। কলমের গাছে জাতের তফাৎ হয় না, তাড়াতাড়ি ফল আসে ও এক বছরের মধ্যে জমিতে লাগান। যায়। এছাড়া গাছ লম্বা অপেক্ষা বেশী ঝড়াল হাওয়ায় ফলন বেশী হয়, ফল পাড়া সহজ হয় ও মধ্যবর্তী পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।

চারা রোপণ : চারা তৈরী হয়ে গেলে বর্ষার আগে চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করা দরকার। বর্ষার আগেই তৈরী জমিতে ৫-৬ মিঃ দূরে দূরে নির্দিষ্ট স্থানে ৯০ x ৯০ x ৯০ সে. মি. গর্ত করা হয়। বর্ষার প্রারম্ভে ২ ঝুড়ি গোবর (১০) কেজি বা খামার পচা সার ও ২৫০ গ্রাম টি এস পি মিশিয়ে গর্তটিকে ভরে ফেলা হয়। এরপর গর্তের তল থেকে ৩-৪ সে.মি. উচু করে মাটি ভর্তি করে গর্থের কেন্দ্রীয় বিন্দুতে চারা লাগান হয়। গাছ থেকে গাছ বা সারি থেকে সারির দূরত্ব নির্ভর করবে জলহাওয়ার তারতম্য, মাটির উর্বরা শক্তি ও গাছের জাতের উপর । উর্বর জমি ও আর্দ্র জলহাওয়ার তারতম্য, মাটির উর্বরা শক্তি ও গাছের জাতের উপর। উর্বর জমি ও আর্দ্র জলহাওয়া হলে দূরত্ব বেশী রাখা হয়, অন্যথায় কম। চারা লাগানোর পর মাটি ভিজে না থাকলে প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন জল না দাঁড়ায়। প্রয়োজনে গাছটিকে কিছুদিন ঠেকা দিতে হবে।

সার ও সেচ প্রয়োগ : যদিও আমাদের দেশে পেয়ারা গাছে সার দেওয়ার রেওয়াজ নেই তবুও, তিন-চার বছরের মধ্যে ফলন পেতে হলে ঠিকমত যত্ন নেওয়া দরকার। প্রতিটি পেয়ারা গাছের বয়সের তারতম্য অনুযায়ী এক থেকে দেড় কেজি নাইট্রোজেন ঘটিত সারের দরকার। এই সারের অর্ধেকটা জৈব সার হিসাবে গোবর সার, খামার পচা সার ইত্যদির মাধ্যমে বর্ষার আগেই গাছের চারদিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

পেয়ারা গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের মাত্রা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলো।

সারণি

সারের নাম রোপণের সময় ১ম বছর ২য় বছর ৩য় বছর ৪র্থ বছর ৫ম এব তদুর্ধ বয়স
গোবর সার (কেজি) ১০ ১০ ১০ ১৫ ২০ ২৫
ইউরিয়া (গ্রাম) ১০০ ২০০ ৩০০ ৪০০ ৫০০
টি এস পি (গ্রাম) ২৫০ ২৫০ ২৫০ ২৫০ ২৫০ ৫০০
এম পি (গ্রাম) ১০০ ১০০ ৩০০ ৩০০ ৫০০

 

পরিচর্যা : মরা ও রোগা ডাল ছাটাই, মাটি কুপিয়ে আগাছা পরিস্কার রাখা, প্রয়োজনমতো পানি সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে । কাজী পেয়ারার মত বেশী ফলনশীল পেয়ারা গাছের ফল পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি ২০টি পাতার জন্য একটি পেয়ারা রাখলে ভাল ওজন ও আকারের ফল পাওয়া যাবে। শীতের প্রথম মাসে গাছের গোড়া হাল্কাভাবে খুঁড়ে কিছু শিকড় বের করে হিম খাওয়ালে ফলন ভাল হয়। এক্ষেত্রে ফুল আসার ২-৩ সপ্তাহ আগে সার মেশানো মাটি দিয়ে শিকড় ঢেকে দিতে হবে। পেয়ারার ডাল বাঁকা করে অন্য ডালের সাথে বেঁধে দিলে বেশি ফলন হয়। পেয়ারা গাছে ফলের মাছি, সাদা মাছি, ছাতরা পোকা ও খোসা পোকার আক্রমণে বেশ ক্ষতি হয়। তাছাড়া কাণ্ডের মাজরা পোকাও খুব ক্ষতি করে। রোগের মধ্যে এনথ্রাকনোজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। সুপারিশকৃত বালাইনাশক ঔষধ দিয়ে পোকা ও রোগ দমন করা যায়। গাছের উপর জাল জড়িয়ে এবং টিন পিটিয়ে বাদুড় তাড়িয়ে পেয়ারা রক্ষা করা যায় ।

ফল সংগ্রহ ও ফলন : পেয়ারা গাছ ১৫-২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে ও ফলন দিতে পারে। লাগানোর ৩ বছর পর থেকে ফলন দিলেও গাছের বয়স ৭-৮ বছর না হলে ঠিকমত ফলন পাওয়া যায় না। একটি ফলন্ত গাছ বছরে ৪০০-১০০০ পর্যন্ত ফল দেবে। এক একর পেয়ারা বাগিচা থেকে ফল বিক্রী করে বছরে ৪০-৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ফুলে পরাগ-সংযোগ থেকে ফল পুষ্ট হতে প্রায় ৪-৫ মাস সময় লাগবে। পুষ্ট হলে ফলের রং ঘন সবুজ থেকে ফিকে হলদে ও উজ্জ্বল বর্ণ হবে। ফল গাছে পাকাতে পারলে ভাল। তবে, পাখির আক্রমণ ও পড়ে নষ্ট হবার ভয় থাকে ।

সাধারণ ব্যবহার : শুধু তাজা ফল সুস্বাদু খাদ্য। জ্যাম ও জেলি হিসাবে সংরক্ষণ আমরা অনেকেই জানি। কাঠ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *