গাছপালা

লেবু গাছ

প্রচলিত নাম : লিম্বু

ইংরেজী নাম : Lemon

বৈজ্ঞানিক নাম : Citus spp.

পরিবার: Rutaceeac

পরিচিতি : আমাদের জীবনে লেবু বিশেষ মর্যাদার অধিকারী পুষ্টিকর ফল। প্রায় সব পরিবারে কম-বেশি লেবুর ব্যবহার হয়। অনেক কাগজি, পাতি, বাতাবি বা জাম্বরা ও জামির এবং কমলা বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য লেবু জাতীয় ফল। এদেশে প্রচুর কমলা খাওয়া হলেও বেশিরভাগ বিদেশ থেকে আনা। কিন্তু অন্যান্য ধরনের লেবু এখানে খুব ভাল জন্মে। লেবু-জাম্বুরা ও কমলার প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, লৌহ, ও ক্যালশিয়াম আছে। বাতাবি লেবু বা জাম্বুরায় যথেষ্ট ভিটামিন-এ আছে। লেবু জাতীয় গাছ সাধারণতঃ ক্ষুদ্রাকৃতি বৃক্ষ বা গুল্ম, পাতায় স্বচ্ছ তৈল গ্রন্থি রয়েছে, ফুলে পাপড়ির সংখ্যা অপেক্ষা পুংকেশরের সংখ্যা চুতুগুণ বা ততোধিক। লেবু বেরী জাতীয় ফল উৎপাদন করে। ফলের রস থলের মধ্যে অবস্থিত।

বিস্তৃতি : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রান্তীয় ও উপ-উষ্ণঅঞ্চল লেবুর আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত ও স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে কারো কারো মতে ভারত-বাংলাদেশে, কেউ বলেন চীন, আবার কেউ বলেন মালয়েশিয়া লেবু গাছের উৎপত্তিস্থল। তবে একটি কথা সবাই স্বীকার করবেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লেবুর পৈত্রিক নিবাস হলেও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এর ব্যাপ্তির ফলে বর্তমানে লেবুর অঞ্চল হয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

জাত : সাইট্রাসগণের উপরোক্ত সদস্যগুলো সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকলে বাংলাদেশে উৎপাদিত বাতাবিলেবু, কাগজী লেবু, পাতি লেবু ও কমলা লেবু সম্বন্ধে যা প্রয়োজনীয় সব জানা যাবে।

১। কমলা (Citocus aurantum Linn.: চীনদেশ কমলার আদি নিবাস। এটি মধ্যমাকৃতি বৃক্ষ। ফল মধ্যমাকৃতির, গোলাকার এবং খোসা ছাড়ানো যায়। নাগপুর, সাঁতরা, খাসিয়া, কোরণ ভারতীয় জাত। কিন্নো, ইউলকিং, এম্পারার প্রভৃতি আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য জাত; পনকান চীন ও ব্রিনডা আলজেরিয়ার নামকরা কমলা। বাংলাদেশের সিলেট, তামাবিল অঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অঞ্চলে কমলার চাষ সীমাবদ্ধ। বর্তমানে সিলেটে কমলার চাষ হয় না বললেই চলে। শীতের মওসুমে ছাতকের কমলা নামে যেটি বাজারে পাওয়া যায় আসলে সে কমলা ছাকতের নয়, ছাতকে বস্তুত কোন কমলাই হয়না। বাংলাদেশে প্রায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে কমলার চাষ হয় এবং উৎপাদন হয় দুই হাজার মেট্রিক টনের মতো। ক্লিমেটিন ইটালী এবং জ্যান্সি যুক্তরাষ্টের প্রধান জাত।

বাতাবী লেবু (Citrus grandis Linn.) : বাতাবী লেবু মধ্যামাকৃতির বৃক্ষ। তুলনামূলকভাবে গাছে কাঁটা কম। পাতার বোটা পক্ষল। মার্চ মাসে পুরাতন শাখার মাথায় নূতন শাখা বৃদ্ধি পায় এবং তথায় নূতন পাতা গজায়। তখন মিষ্টি গন্ধযুক্ত সাদা ফুলও ফোটে। বর্ষার শেষে ফল পাওয়া যায় । Pumelo বা shaddock এর ইংরেজী নাম। ফল বড় এবং খোসা বেশ পুরু। বাংলাদেশে বাতাবী লেবুর জাত প্রকরণের ব্যাপারে বিশেষ কোন কাজ হয় নি। যদিও অনেক ভালো জাতের বাতাবীলেবু বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। রুবী, ডানকান, ফষ্টার, থম্পসন প্রভৃতি ভারতীয় জাত। কাওপ্যান থাইল্যানড এবং নুনটান ফরমোজার উল্লেখযোগ্য জাত। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বাতাব লেবু বা জাম্বুরার চাষ হতে দখো যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, রংপুর, নোয়াখালী, পাবনা, মোমেনশাহী, যশোর, দিনাজপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলে কম-বেশী বাতাবী লেবুর চাষ হয়। অন্যান্য অঞ্চলেও এ গাছটি দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার আটশত হেক্টর জমিতে এর চাষ হয় এবং সাড়ে সাত হাজার মেট্রিক টন বাতাবী লেবু উৎপাদিত হয়। এর আদি নিবাস থাইল্যান্ড এবং থংড়ি, কাওফুয়াং ও কাওপন বিশিষ্ট থাই জাত।

৩। পাতি লেবু, কাগজী লেবু (C. Limon. C. aurantifolia, C. timettoides, C. medica.) : কাগজী বা পাতি লেবু গাছ ছোট ও ঝোপের মতো। কাগজী লেবু গাছে কাঁটা অসংখ্য। পাতা তুলনামূলকভাবে বাতাবী লেবু হতে ছোট, ফল সবুজ এবং ছোট আকারের। জাত বিশেষে ফলে কমবেশি বীজ হতে দেখা যায়। পাতি লেবু কমবেশী দেশের নানা বাজারে সারাবছরই পাওয়া যায়। কাগজী লেবুও পাতি লেবুর মতোই দেখা যায়, তবে ইহা বর্ষাকালে বেশী পাওয়া যায়। শিঠা লেবু/শরবতী সম্পূর্ণ মিষ্টি নয়। দেশের কোন কোন অঞ্চলে এ চাষ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে বেশি পাতি লেবু ও কাগজী লেবুর চাষ হয় এবং অন্যান্য অঞ্চলে কম-বেশী এ জাতীয় লেবুর চাষ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে পাতি লেবু, কাগজী লেবু প্রভৃতির চাষ হয় এবং দেশের গড় উৎপাদন আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার মেট্রিক টন।

মাটি ও জলবায়ু : পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের মাটিতে লেবু চাষ হয়। বেলে মটি, লাল পাহাড়ী মাটি, বেলে দো-আঁশ এমনকি এটেল মাটিতেও লেবু চাষ হতে দেখা যায়। মাটির প্রকৃতি যাই হোক এটি সুনিষ্কাশনক্ষম হতে হবে। অবশ্য গভীরতাযুক্ত শিথিল মাটি লেবু চাষের জন্য উৎকৃষ্ট। অল্প ক্ষার (PH, থেকে অম্ল (PH, পর্যন্ত সব মাটিতেই লেবু গাছ হয়। কমলালেবু অম্ল (PH..) মাট বেশী পছন্দ করে। কমলা লেবু অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ও বেশী বৃষ্টিপাত পছন্দ করে। কিন্তু বাতাবী লেবু, কাগজী বা পাতি লেবু বেশী ঠান্ডা ও তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। তুষারপাত হলে গাছ মরে যায়। ফলের স্বাদও খারাপ হয়ে যায়। সুতরাং আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি। সিলেট, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে কমলার চাষ বাড়ালে যথেষ্ট সুফল পাওয়া যাবে। তবে সমস্যা হলো আর্দ্র জালবায়ুতে ফলে রস বেশ হবে বটে কিন্তু খোসা পাতলা হবে, স্বাদ পানসে হবে এবং ফলে ঠিকমত রং আসবে না। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা, বাতাবী ও কাগজী লেবু চাষের জন্য উপযোগী।

চারা তৈরী : লেবুচারা বীজ ও কলম দু’ভাবেই তৈরী করা যায়। অন্যান্য ফলের মতো বীজ থেকে উৎপন্ন চারার প্রজাতি সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা থাকে না। আবার বংশপরম্পরায় একই গাছ থেকে কলমের মাধ্যমে চারা তৈরী করলে চারার তেজ কমে যায়। এ কারণে মূলাধার ব্যবহার করার পদ্ধতি সর্বত্র প্রচলিত। সাধারণত পুষ্ট কিন্তু সম্পূর্ণ পাকা নয় এমন ফল থেকে বীজ আলাদা করে, বীজের উপরের হড়হড়ে পদার্থটা ছাই মিশিয়ে নষ্ট করে, ভালোভাবে পানিতে ধুয়ে ছায়ায় শুকাতে হয়। প্রয়োজনমতো বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। কোথাও পাকা ফল সরাসরি মাটিতে লাগানো হয়, পরে চারা বেরোলে নির্দিষ্ট জায়গায় রোপণ করা হয়। চারা বেরোলে ১৫০ নিযুক্তায়শ জিবরিলিক এসিড দ্রবণ পাতায় ছিটালে গাছের বাড় ভালো হয়। বীজের চারা দুই বছরের মধ্যে রোপণ করা চলে। মনে রাখতে হবে যে, লেবুর বীজ বেশীদিন সংরক্ষণ করা যায় না। রোদে বীজ শুকাতে নেই। C. medica. C. grandis ব্যতীত সব প্রজাতির লেবুতে বহুভ্রণিতা বিদ্যমান। অর্থাৎ বাতাবী লেবু ও পাতি লেবু ছাড়া সব লেবুর বীজ থেকে একাধিক চারা গাজায়। এসব চারার মধ্যে একটি যৌন ও বাকিগুলো অযৌন । সাধারণতঃ যৌন চারা অযৌন চারা অপেক্ষা দুর্বল হয়ে থাকে। অযৌন চারার পাতায় গাছের সব বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকে। লেবুর বীজ শুকিয়ে গেলেই অঙ্কুরণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এজন্য বীজ পাকা ফল থেকে আলাদা করার পর দেরী না করে বপন করতে হয়। ১৫° /১৬৭ সেলসিয়াস তাপমাত্রার নীচে বীজ অঙ্কুরিত হয় না। লেবুর বীজ বেশীদিন সংরক্ষণ করতে হলে হাইড্রোক্সি কুইনোলিন সালফেট দিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হয় ।

শাখা কলম, গুটি এবং অঙ্গ ও কুঁড়ি সংযোজন করেও লেবুর বংশ বিস্তার করা যায়। বাংলাদেশে বীজের চারা, গুটি কলম ও শাখা কলম দিয়ে লেবুর বংশ বিস্তার করা হয়। বিশেষজ্ঞ মহল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী খামার বাতাবী লেবুকে ও জালী লেবুকে শিকড়ভিৎ হিসাবে ব্যবহার করে কুঁড়ি সংযোজন করে থাকে। শিকড়ভিৎ নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে এটি জলবায়ু ও মাটির উপযোগী, সংশ্লিষ্ট সায়নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এবং রোগ-প্রতিরোধে কতটুকু ক্ষমতাসম্পন্ন। লেবুর যে কোন প্রজাতির উপর অন্য প্রজাতির কুঁড়ি সংযোজন করা সম্ভব। কুঁড়ি সংযোজনে প্রধান সুবিধা এই যে, স্থানীয় অবস্থার উপযোগী শিকড়ভিৎ ব্যবহার করা যায় এবং সায়ন হিসাবে কুঁড়ি ব্যবহারে রোগ-প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কুঁড়ি সংযোজনে ৮০-৯৩% সাফল্য আসে। নির্দিষ্ট মূলাধারে চোখ বসিয়ে টি বা এল পদ্ধতিতে চোখ কলম করা হয়। মার্চ-জুলাই মাসে টক লেবু ত্ৰিপত্ৰকী লেবুর উপর কমলা, মাল্টা, কাগজি ও ৮৫% সাফলতা পাওয়া যায়। চোখের সঙ্গে কিছুটা অপুষ্ট কাঠ রাখা ভাল, তবে কাগজি লেবু ছাড়া অন্য লেবুতে বিশেষ প্রয়োজন নেই। কলম করার পরই কলমের উপরের দিকে (২-৩টি চোখ ছেড়ে দিয়ে) ডালটি ঘেঁটে দেয়া দরকার। অনেক সময় কেবল ছালটুকু ছাড়িয়ে চোখসহ একটি শাখা ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ইনডোল এসিটিক এসিড কলমের জায়গায় প্রলেপ দিলে তাড়াতাড়ি কলমের বৃদ্ধি হয়।

লেবু গাছের মূলাধার নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। কমলা, টক লেবু মূলাধার হিসাবে ব্যবহার করলে আঠা পাড়া ও গুকো রাগ হয় না । ট্রাইফলিয়েট লেবু মূলাধার হিসাবে খুব ভালো-ক্যাংকার বা মরচে পড়া রোগ প্রতিরোধ করে এবং কাণ্ডে প্রচুর কাটা থাকায় ফলের উপর বাইরের হামলা বা চুরি কম হয়। রংপুর লেবু মোসাম্বীর আদর্শ মূলাধার হিসেবে ভারতে চিহ্নিত হয়েছে। তাড়াতাড়ি চারা তৈরীর জন্য অনেক সময় লেয়ারিং বা দাবা কলম করা হয়। কাগজী, পাতি ও মোসাম্বি গাছের লেয়ারিং করলে ২ মাসের মধ্যে শতকরা ৭০-৯০ চারা পাওয়া যায়। বর্ষার প্রথমেই দাবা কলম করার নিয়ম এবং তিন মাসের মধ্যে চারা তৈরী হয়ে যায়। মাতা-গাছ থেকে কলম সরিয়ে এক মাসের মতো নার্সারীতে রেখে জমিতে লাগানো উচিত।

লেবুর গুটি কলমে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ সাফল্য আসে। বর্ষার প্রারম্ভে গুটি কলম করতে হয়। গুট বা দাবা কলমের জায়গায় ১% ন্যাপথলিন বা ১% ইনডোল এসিটিক এসিড ব্যবহার করে ১০০% সফলতা পাওয়া যায়।

টিস্যু কালচারের মাধ্যমে লেবুর বংশবিস্তার এর কাজ চলছে নানা দেশে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অনেক পিছনে পড়ে আছে। ভারতে বাতাবি লেবু ও মিঠা লেবুর কাণ্ড ও পাতার টিস্যু কালচারের মাধ্যমে বংশবদ্ধির অগ্রগতি হয়েছে অনেক।

চারা রোপণ : বাংলাদেশে মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে লেবুর চারা লাগানো উচিত। চারার জাত প্রকরণ, জলবায়ু ও চাষ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে চারার দূরত্ব স্থির করতে হয়। কাগজি বা পতি লেবুর বীজ থেকে তৈরী চারা ২.৫-৩.৫ মিটার দূরত্বে লাগানো উচিত। বাতাবি লেবুর চারা ৬.৫ মিটার দূরত্বে লাগাতে হবে। বাড়ীর খালি জায়গায়, পতিত জমির উচু-নিচু স্থানে ও পাহাড়ী ঢালে ৫-৫.৫ মিটার দূরত্বে বাতাবী লেবুর চারা রোপণ করা যায়। বীজ থেকে তৈরী কমলার চারা ৮ মিটার ও কলমের চারা ৬ মিটার দূরত্বে রোপণ করা যায় । পূর্ণাঙ্গ গাছের উচ্চতা, পরিধি প্রভৃতির দিকে খেয়াল রেখে চারা লাগাতে হবে এবং দেখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে গাছে গাছ জড়িয়ে না যায়। পরিমিত দূরত্বে চারা রোপণ করলে ভবিষ্যতে মাধ্যমিক পরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়। ৫০ বা ৬০ সে.মি. চওড়া বা একই পরিমাণ গর্ত করে প্রতি গর্তে এক টুকরী গোবর সার, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ মাটির সাথে মিশিয়ে চারা রোপণ করা উচিত আর মাটি সপ্তাহখানেক রোদে শুকিয়ে নেয়া ভালো। রোপণের পরই সেচ দেয়া প্রয়োজন।

সার প্রয়োগ : গাছের ভালো বৃদ্ধি ও ফলন হতে হলে লেবু চাষে সার ঠিকমতো প্রয়োগ করতে হবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, গন্ধক, লোহা, দস্তা, তামা প্রভৃতি লেবু গাছের জন্য দরকারী।

নাইট্রোজেন গাছের প্রয়োজনীয় সার। অধিক বা অল্প প্রয়োগ গাছের ক্ষতি হয় ও ফলের স্বাদ খারাপ হয়। ফুল আসার সময় প্রয়োগে গাছের ক্ষতি হয় ও ফলের স্বাদ খারাপ হয়। ফল ধরার পর এটি প্রয়োগ করলে ফলের খোসা মোটা হয় এবং ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। প্রতিটি লেবু গাছে বছরে ০.৫-১.০ কেজি নাইট্রোজেন সার দরকার হয়। প্রতি হেক্টরে ৫০-৭০ কেজি নাইট্রোজেন অর্থাৎ ১২০ – ১৫০ কেজি ইউরিয়া দরকার।

সারণি

সারের নাম ১-৩ বছর বয়স ৪-৫ বছর বয়স ৬ এবং অধিক বছরের
গোবর/আবর্জনা পচা সার ১৫ কেজি ২০ কেজি ২৫-৪০ কেজি
ইউরিয়া ২০০ গ্রাম ৪০০ গ্রাম ৫০০ গ্রাম
টিএসপি। ২০০ গ্রাম ৩০০ গ্রাম ৪০০ গ্রাম
এমপি ২০০ গ্রাম ৩০০ গ্রাম ৪০০ গ্রাম

 

কমলা লেবু গাছের বছরে ৩০০ গ্রাম ফসফরাস দরকার হয়। প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ৫০-৬০ কেজি ফসফরাস অর্থাৎ ২২৫-২৫০ কেজি সুপার ফসফেট দরকার। গাছের পাতায় ১% পটাশ থাকলে বুঝতে হবে চাহিদা মোতবেক পটাশ রয়েছে। ০.৫% বা তার কম হলে পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। ন্যূনতম পটাশ না থাকলে গাছ নাইট্রোজেন ব্যবহার করতে পারে না। আবার বেশী পটাশ থাকলে গাছ বেশী নাইট্রোজেন নিয়ে অন্যান্য সারের সমতা নষ্ট করবে, ফলে বীজ ও অম্লত্ব বাড়াবে।

লেবু গাছে চুন, ম্যাগনেশিয়াম, লোহা, গন্ধক, দস্তা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, সোহাগা প্রভৃতির দরকার হতে পারে। সালফার সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় নি। তবে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ প্রয়োগেই সালফারের চাহিদা মিটাতে পারে। ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে পাতা হলদে হয়ে ঝড়ে যায়। ম্যাগনেশিয়াম সালফেট বা নাইট্রেট অবস্থায় হেক্টর প্রতি ১২ কেজি প্রয়োগের সুপারিশ রয়েছে। জিঙ্ক বা দস্তার অভাবে পাতা ছোট হলুদাভ হয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। প্রতি হেক্টরে ৪০ গ্রাম দস্তা প্রয়োগের সুপারিশ রয়েছে। ম্যাঙ্গনিজের অভাবে দস্তা ও লোহার অভাব বেশী দেখা দেয়। পাতার কুঁড়ি কোঁকড়ানো ছাড়াও পাতা ছোট হয়ে যেতে দেখা যায়। প্রতি হেক্টরে ১০০ গ্রাম লোহা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অন্যান্য গৌণ খাদ্যোপাদান তামা ও মলিবডিনাম এর অভাবজনিত কারণ মেটানোর জন্য ১০০ গ্রাম করে তামা ও সোহাগা প্রতি হেক্টরে প্রয়োগের সুপারিশ রয়েছে। তামার অভাবে শুকো রোগ হতে পারে।

সেচ প্রয়োগ : সময়মতো সেচ দিলে গাছে পাতার সংখ্যা বাড়ে এভং গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়। মাটির প্রকৃতি ও গাছের অবস্থা দেখে মাসে ২/৩ বার সেচ প্রয়োগের সুপারিশ রয়েছে। ঘন ঘন অল্প সেচ দিলে শিকড় মাটির গভীরে যাবে না এবং নানা রোগের আক্রমণ হবে। অন্যদিকে বেশী ও পর্যাপ্ত সেচ প্রয়োগে গাছের ডালপালা ও পাতা বেশী হবে এবং ফলন কম হবে।

মাধ্যমিক পরিচর্যা : সাধারণভাবে বাংলাদেশে লেবুতে ছাঁটাইয়ের প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় যেখানে প্রচুর লেবু চাষ হয় যেখানে গাছ ঘেঁটে দেয়া প্রয়োজনীয় মাধ্যমিক পরিচর্যা। বাংলাদেশেও গাছের আকৃতি সুন্দর রাখার জন্য ছাঁটাই প্রয়োজন। অযৌন পদ্ধতিতে তৈরী গাছের গোড়া থেকে বেশী ডালপালা বেরোলে তা কেটে দিতে হবে। মাটি থেকে জাত অনুযায়ী ৭০/১০০ সে.মি. পর্যন্ত প্রধান কাণ্ড শাখাহীন রাখা উত্তম। ফল সংগ্রহের পর হালকাভাবে ডাল ঘেঁটে দিলে নুতন ডাল বেরোতে পারে এবং পরের বছর নাতে ফুল আসতে পারে। কাগজী ও পাতি লেবু শীতের সময় হেঁটে দিলে গ্রীষ্মের প্রথমে প্রচুর ফুল আসে। ঠিকমতো ব্যবস্থা নিলে বা পরিচর্যা করলে কাগজী, পাতি প্রভৃতি লেবুতে বছরে তিন বার ফুল আসতে দেখা যায় । অনেক ক্ষেতে মাধ্যমিক ফসলও চাষ করা যায়। তবে লেবুতে নিয়মিত ফল ধরা আরম্ভ হলে মাধ্যমিক ফসলের চাষ বন্ধ করতে হবে। মটর, ছোলা, খেসারী ও মসু ডাল মাধ্যমিক ফসল হিসেবে উৎকৃষ্ট। মাটির রস রাখার জন্য ভালোভাবে চাষ দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি শুকনো ঘাস-পাতা বা খড় দিয়ে ঢেকে রাখা ভালো।

ফল সংগ্রহ ও ফলন : বাংলাদেশে কাগজী লেবু ও পাতী লেবুর ফল সারাবছরই পাওয়া যায়। একই গাছে বার মাস ফল হতে পারে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস কমলার প্রধান ঋতু। বর্ষার শেষে বাজারে বাতাবী লেবু পাওয়া যায়। জাতের উপর নির্ভর করে ফুল আসা থেকে ফল তৈরী হওয়া পর্যন্ত ন’মাস সময় লাগে। কতকগুলো অর্থাৎ কাগজী লেবুতে তিন মাসের মধ্যে ফল পেকে যেতে দেখা যায়। ফল পুষ্ট হলে রং বদলাতে আরম্ভ করে । যতই পরিণত হবে ততই ত্বক মসৃণ হবে ও হলুদ রং ধারন করবে। তৈলরগুলো স্পষ্ট হলে ফল তোলার উপযুক্ত হয়। লেবু পুরাদমে পাকলেও বেশ কিছুদিন গাছে রাখা চলে। কিন্তু কমলালেবু পাকলেই পেড়ে নিতে হয়। বাংলাদেশে হাতেই লেবু সংগ্রহ করা হয়। গাছের বয়স, জাত প্রভৃতির উপর লেবুর ফলন নির্ভরশীল। ফলন সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন এবং বাংলাদেশে এ নিয়ে কাজ তেমন একটা হয়নি। জাতের তারতম্য অনুসারে পাঞ্জাবে প্রতি বছর কমলা, মোসাম্বি, মাল্টা প্রভৃতিতে ১২৮ থেকে ৫৪০টি ফলের ফলন রেকর্ড করা হয়েছে।

সাধারণ ব্যবহার : লেবুর ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পুষ্টিমান ভিন্নতর। মিষ্টি লেবু অর্থাৎ কমলা, মাল্টা প্রভৃতিতে শর্করা অর্থাৎ গ্লুকোজ ও সুক্রোজ-এর পরিমাণ বেশী রয়েছে এবং অম্ল লেবুতে অম্লের পরিমাণ বেশী। লেবুর খোসায় রয়েছে পেকটিন ও মূল্যবান তেল। লেবুতে রয়েছে প্রচুর এসকরভিক এসিড, ভিটামিন সি। মধুর রসসম্পন্ন কমলা, মাল্টা, মোসাম্বি প্রভৃতি তৃপ্তিদায়ক ও তৃষ্ণানিবারক। লেবু রস, জেলী প্রভৃতি আকারে প্রক্রিয়াজাত করে বহুদিন রাখা যায়। ফলের খোসা ও পাতা দিয়ে প্রসাধনী ও সুগন্ধী তেল তৈরি করা হয়। ফলের খোসা আচার ও চাটনীতে ব্যবহার্য । সিলেট ও আসামের কোন কোন অঞ্চলে সাতকরা নামক লেবুর খোসা সবজী হিসাবে সমাদৃত। বাণিজ্যিক আকারে সাইট্রিক এসিড তৈরীর নিমিত্তে কোন কোন জাতের বিশেষ করে কাগজী লেবু, পাতি লেবু প্রভৃতির ভিন্নভাবে চাষের প্রচলন রয়েছে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার কোন কোন দেশে। লেবু ক্ষুধাবর্ধক, মেদনাশক, কফ ও পিত্তনাশক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *