গাছপালা

নিম গাছ

প্রচলিত নাম : নিম

ইংরেজী নাম : Neem

বৈজ্ঞানিক নাম : Azadirachta indica A.Juss.

পরিবার : Meliaceae

পরিচিতি : নিম মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। তবে শুষ্ক জায়গায় পত্রঝরা বৃক্ষের ন্যায় আচরণ করে। গাছ সাধারণতঃ ১২-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় এবং গোড়ার ব্যাসার্ধ ৬০-৮০ সে. মি. পর্যন্ত হয়। গাছ বা নোটা ডালের বাকলের রং গাঢ় ও অমসৃণ হলেও অপেক্ষাকৃত কচি ডালের রং খয়েরী। গাছের বাকল অপেক্ষাকৃত নোটা। ডালের চারিদিকে উপর-নীচে করে ৩০ থেকে ৩৫ সে.মি. লম্বা যৌগিক পত্র জন্মে। প্রতিটি পাতায় ১০ থেকে ১৭টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। প্রতিটি পত্রক ৬-৮ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতায় জোড় এবং বিজোড় সংখ্যক পত্রক উভয়ই থাকতে পারে। ৪৫০-১১৫০ মি.মি. বৃষ্টিপাত নিম গাছের জন্য উত্তম।

বিস্তৃতি : নিম বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও উত্তরাঞ্চলে বেশী পাওয়া যায়। এর আদি নিবাস মায়ানমারে। বর্তমানে এ উপমহাদেশেসহ উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলীয় সবদেশেই নিম গাছের বিভিন্ন প্রজাতি ছড়িয়ে আছে।

বীজ সংগ্রহ : জুন-জুলাই।

বীজের ওজন : কেজিতে ৩৩০০-৪৫০০টি।

বীজ সংগ্রহ ও চারা উত্তোলন : গাছ থেকে অথবা গাছের নীচ থেকে সরাসরি বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে পরিপক্ক নিম গাছে ফুল দেখা যায়। জুন-জুলাই মাসে হলুদ রংয়ের ডিম্বাকৃতি পরিপক্ক ফল পাওয়া যায়, ফল ১২-১৮ সে.মি. লম্বা হয়। প্রতিটি ফলেই একটি করে বীজ থাকে। ফলের তৃক ছড়িয়ে ছায়ায় শুকিয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে পাত্রের মাটিতে বপন করতে হয়। বীজ বপনের ৭-১০ দিনের মধ্যে চারা গজায়। বীজ অংকুরোদগমের হার শতকরা ৭০-৮০ ভাগ।

উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি : সাধারণত নিমগাছ খোলামেলা জায়গায় বেশী দেখা যায়। যেমন: রাস্তার আশেপাশে, সমতল ভূমিতে ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়। সব ধরনের মাটিতে নিমগাছ জন্মে। তবে বেলে, দো-আঁশ মাটিতে অধিক পরিমাণে জন্মে।

সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি :

পাতা : পাতা সংগ্রহ করে পরিস্কারপূর্বক রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে। অতঃপর পাতার আর্দ্রতা কমে কিছুটা গাঢ় বর্ণ ধারন করলে প্যাকেটজাত করতে হয়। পাতার প্যাকেট অবশ্যই সঠিক সনাক্তকরণ ব্যবহারবিধিসহ বাজারজাত করতে হবে।

বীজ : বীজ পরিপক্ক হলে সংগ্রহ করতে হবে। তবে মাটিতে না পড়ার জন্য ঘন জাল দিয়ে গাছকে বেঁধে দিলে সবগুলো বীজই প্রায় সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এমতাবস্থায় বীজকে ধুয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে আর্দ্রতা শতকরা ২ ভাগ থাকতে হবে। বীজ শুকানোর পর প্যাকেট করে সংগ্রহ করতে হবে।

ছাল : নিমের ছাল কেটে টুকরো টুকরো করে নিতে হবে। অতঃপর ভাল করে ধুয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে আর্দ্রতা শূন্যভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

ঔষধি গুণাগুণ : রক্ত পরিস্কারক, জীবাণুনাশক, চর্মরোগ, ব্রণ, কৃমি ও ক্ষত নিবারক। শরীরে জ্বালাপোড়া, এলার্জি ও মুখের দুর্গন্ধনাশক । দাঁতের রক্তপড়া বন্ধ করে এবং দাঁতের মাড়ি সবল করে। তাছাড়া স্বপ্নদোষ ও জন্ডিস প্রশমক।

ঔষধি ব্যবহার :

১) রক্ত পরিস্কার ও চর্মরোগে : কাঁচা নিম পাতা ১০ গ্রাম ২ কাপ পানিতে জ্বাল করে ১(এক) কাপ অবশিষ্ট থাকতে হেঁকে নিয়ে প্রয়োজন মতো চিনি মিশিয়ে সেব্য। উল্লিখিত নিয়মে প্রত্যহ ২-৩ বার, নিয়মিত ১-২ মাস সেবন করে যেতে হবে ।

২) স্বপ্ন দোষ প্রশমনে : নিম ছালের রস ১-২ চা চামচ ১(এক) গ্লাস পরিমাণ গরুর দুধে মিশিয়ে রাত্রে শয়নকালে সেবন করলে স্বপ্নদোষ প্রশমিত হয়।

কৃমি নিরসনে : ৩-৪ গ্রাম নিম ছাল চূর্ণ সামান্য পরিমাণ সৈন্ধব লবনসহ সকালে খালিপেটে সেবন করে গেলে কৃমির উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়া যায়। নিয়মিত এক সপ্তাহ সেবন করে যেতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১-২ গ্রাম মাত্রায় সেব্য।

৪) খোস-পাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতে : নিম পাতার সাথে সামান্য কাঁচা হলুদ পিষে নিয়ে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ আকারে ৭-১০ দিন ব্যবহার করলে খোস-পাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতের উপশম হয়।

৫) নিমের প্রধান ব্যবহার চর্মরোগে ও বীর্যনাশক হিসেবে। চুলকানি বা খোস-পাঁচড়া হল নিমের পাতা বা বাকল বেটে পরপর ৩/ ৪ দিন গায়ে মেখে দুই ঘন্টা পর গোসল করে ফেললে সেরে যায়। বাকল পানিতে সেদ্ধ করে ঐ পানি দিয়ে গোসল করলেও একই উপকার পাওয়া পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে গাছের বাকলের চেয়ে শেকড়ের বাকল বেশী উপকারী। এছাড়া, নিম পাতা বেটে ছোট ছোট বড়ি করে রোদে শুকিয়ে প্রতিদিন সকালে একটি করে খেলে খোস-পাঁচড়া সেরে যায়। নিম পাতা কড়াইতে ভেজে চূর্ণ করে ভাতের সাথে খেলেও অনুরূপ উপকার পাওয়া যায়।

৬) বসন্ত রোগে রোগীকে নিম পাতার বিছানায় শোয়ানো জীবাণুনাশক হিসেবে ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। নিমের এই জীবানুধ্বংসকারী গুণের জন্য ফোড়া, কাটা-পোড়ার ক্ষত, দাদ, একজিমা, স্ক্যাবিস, খুসকিসহ বিভিন্ন জটিল চর্মরোগে নিমপাতা বাটা ও ছালের প্রলেপ দিলে অল্প সময়ে সেরে যায়।

৭) শ্বাসকষ্ট এবং দুর্বলতায় নিম ফুল উপকারী। এছাড়া, বাতজ্বরে নিম তেল ব্যবহার সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত। নিম বীজের গুঁড়াও নিম তেলের ন্যায় কার্যকরী, তবে বীজের গুঁড়া পানি ও অন্য তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়।

৮) পোকা-মাকড় দমনেও নিমের ব্যবহার রয়েছে। শুকনো নিমপাতা ধান, চালের গোলায় বা ডাল, গমের পাত্রে রাখলে এসব খাদ্যশস্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। বর্ষাকালে আলমারীতে রাখা কাপড়-চোপড়ে বাজে গন্ধ হয়। তাছাড়া এসব কাপড়-চোপড় অনেক সময় পোকায় কেটে নষ্ট করে। এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে আলমারীর এক কোণে কিছু শুকনো নিম পাতা ঝুলিয়ে রাখা যায়।

৯) নিম পাতা বেটে পানিতে মিশিয়ে পোকা আক্রান্ত ক্ষেতে প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়।

১০) মুখে অরুচি হলে সুজির হলুয়ার সাথে অল্প নিমপাতা গুঁড়া মিশিয়ে কয়েকদিন খেলে মুখে রুচি ফিরে আসে।

১১) চাপা অম্লরোগে সকালে খালি পেটে ৪/৫ গ্রাম নিমপাতা চূর্ণ কয়েকদিন খেলে উপকার পাওয়া যায়। ১২) কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বাটা চর্মরোগে খুব উপকার দেয়। নিমাপাতা, হলুদ গুঁড়া আর গন্ধকচূর্ণ সরিষা তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে খোস পাঁচড়া কমে যায়। সকালে দুই চামচ নিম পাতার রস সাতদিন খেলেও খোস পাঁচড়া সেরে যায়।

১৩) নিমপাতা চূর্ণ এক ভাগ, কাঁচা হলুদ শুকিয়ে চূর্ণ করে দুই ভাগ এবং শুকনো আমলকি চূর্ণ তিন ভাগ একসঙ্গে মিশিয়ে তার এক গ্রাম প্রতিদিন সকালে খেলে এলার্জি সেরে যায়।

১৪) ঘুষঘুষে জ্বর হলে ২৫০ মি. গ্রাম নিমপাতা চূর্ণ এক বা দেড় রতি মকরধ্বজসহ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কমে যায়।

১৫) পিত বিকারে যদি দাঁতের মাড়িতে ঘায়ের সৃষ্টি হয়, তাহলে নিমের বিচির তেল লাগালে কমে যায়। ১৬) নিমপাতা বেটে ফোঁড়ায় প্রলেপ দিলে তা পেকে যায়।

১৭) রাতকানা রোগে নিমের ফুল ভাজা খাবেন।

রাসায়নিক উপাদান : নিমের ছাল, ফুল, ফল ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান যেমন : স্যাপোনিন, এলকালয়েড, নিমবিডিন, নিম্বিন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব-এসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন প্রভৃতি বিদ্যমান।

বাজার চাহিদা : অনাদিকাল হতে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে নিমের বিভিন্ন অংশ অত্যন্ত কার্যকরী উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নিমের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে যাচ্ছেন। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিও ঔষধ শিল্পে নিমের ছাল, পাতা, বীজ ফল প্রচুর ব্যবহৃত হয়। পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব ঔষধ শিল্পে প্রতি বছর নিম ছাল, নিম বীজ ও নিম পাতা প্রায় ৫০০ টনের মতো ব্যবহৃত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *