ছাতিয়ান বা ছাতিম বা সপ্তপর্নী গাছ
ছাতিয়ান গাছ
প্রচলিত নাম : ছাতিম, সপ্তপর্নী
ইংরেজী নাম : Devils Tree
বৈজ্ঞানিক নাম : Alstonia scholaris R. Br.
পরিবার : Apocynaceae
পরিচিতি : বড় ধরনের চিরসবুজ ঘন পাতাযুক্ত গাছগুলি ১৫-২০ মিটার পর্যন্ত উচু হয়। কাণ্ডের চারদিকে শাখা এবং শাখার চারিদিকে মনসা পাতার মত ৪-৭টি পাতা ছত্রাকারে ছাড়ানো থাকে। সম্ভবতঃ এজন্য এর নাম ছাতিম । আবার প্রায় সব শাখারই। ৭টি পাতা সাজানো থাকে তাই এর অন্য নাম সপ্তপর্ণা বা সপ্তপর্ণী। পাতা ১০-২০ সে.মি. লম্বা হয়। গাছের পুরু বাকল/ছালের উপরিভাগ খসখসে, অমসৃণ ও গাঢ় বাদামী বর্ণের এবং ভিতরটা সাদা ও দানাযুক্ত। গাছের সকল অংশে তিক্ত স্বাদের সাদা দুধের মত আঠা থাকে। বাংলা সাহিত্যে বিদগ্ধজনের কাছে ছাতিম নামটি বহুল পরিচিত। বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর প্রমাণপত্রের প্রতীক স্বরূপ দেওয়া হয় এই সপ্তপণীয় পত্র ।
বিস্তৃতি : বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ এশিয়ার প্রায় সর্বত্রই এটি পাওয়া যায় । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মিটার উঁচুতেও এটি জন্মায়। তবে সমভূমিতে এ গাছ দ্রুত বাড়ে। বাংলাদেশের রাস্তার আশেপাশে ছাতিম গাছে নজরে পড়ে।
বীজ সংগ্রহ : ফেব্রুয়ারী-মার্চ
বীজের ওজন : কেজিতে ২,৫০,০০০-২,৮০,০০০টি।
বীজ আহরণ ও চারা উত্তোলন : অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বোঁটাহীন থোকা ফিকে সবুজ ফুল ফোটে। ফুলে তীব্র সুগন্ধ রয়েছে। সরু বরবটির ন্যায় ফল ৩০-৬০ সে.মি. লম্বা হয়। জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে পাকলে বাদামী রংয়ের ফল সংগ্রহ করে ২-৩ দিন কাপড় দিয়ে ঢেকে শুকিয়ে নিতে হয়। পরে মাড়াই করে বীজ আলাদা করে নিতে হয়। প্রতি ফলে গড়ে ৮-১০টি বীজ থাকে। বীজ কয়েকমাস সংরক্ষণ করা যায়। বীজ অত্যন্ত হালকা হওয়ায় মার্চ মাসে কাঠের গুঁড়া বা বালির সাথে মিশিয়ে বপন করতে হয়। বীজ অংকুরোদগম হার শতকরা ৫০-৬০ ভাগ। কাটিং বা কপিচের চেয়ে বীজ থেকেই চারা তৈরী সহজ ও উত্তম। নার্সারীতেও চারা পাওয়া যায়। চারাগাছ বাংলাদেশের সর্বত্রই লাগানো যায়। তবে রাস্তার পাশে লাগানো ভাল।
ঔষুধি ব্যবহার :
১) ছাতিম ছালের প্রধান ও প্রচলিত ব্যবহার কুষ্ঠ রোগে। কোন জায়গায় সাদা বা লাল দাগ দেখা গেলে, জায়গাটা একটু উঁচু ও বোধহীন হলে বোঝা যায় এটি কুষ্ঠের লক্ষণ। এক্ষেত্রে (ক) ছাতিম ছালচুর্ণ এক গ্রাম, এক চা চামচ গুলঞ্চের রস মিশিয়ে খেতে হবে। (খ) ১০/১২ গ্রাম ছাল তিন কাপ জলে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ঐ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে । অথবা (গ) ৪০/৪৫ গ্রাম ছালকে থেঁতো করে ৫০০ মি.লি. পানিতে খানিকক্ষণ সেদ্ধ করে ছেকে সেই পানি গোসলের পানির সাথে মিশিয়ে গোসল করলে রোগ নিরাময় হয়। এটি চরক সংহিতার ব্যবস্থা।
২) কফের আধিক্যসহ হিক্কশ্বাসে ছাতিম ছালের আধা চা চামচ রস চার ভাগের এক কাপ দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে উপশম হয়।
৩) সর্দিবিহীন হাঁপানিতে এক থেকে দেড় গ্রাম ছাতিম ছালের গুঁড়া ২৫০ মি.গ্রা. পিপুল চূর্ণ দুই-এর মাড়ের সাথে মিশিয়ে খেতেন হয়।
৪) ঠাণ্ডা লেগে বুকে সর্দি বা শ্লেষা বসে গেলে পানি মিশানো দুধে ১ গ্রাম ছাতিম ছাল গুড়ো দিয়ে অল্পক্ষণ ফুটিয়ে সেটা খেতে হবে। এতে সর্দিটা তরল হয়ে উঠে আসবে।
৫) মায়ের বুকের দুধ কমে গেলে ৫/৬ গ্রাম ছাতিম ছাল ঘেঁচে/থেতো করে ২ কাপ পানিতে মিশিয়ে সেদ্ধ করে আধা কাপ হলে নামিয়ে হেঁকে তার সাথে আধা কাপ দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। এতে দুধ বেড়ে যাবে । ৬) ছাতিমের আঠা ৮/১০ ফোটা গরম পানিতে মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে গরগল করলে বা সম্ভব হলে ২/৪ মিনিট মুখে পুরে ফেলে দিতে হবে। এভাবে একদিন পরপর করলে পাইরোরিয়া ভাল হয়।
৭) কোন ব্রণের ক্ষত কোনভাবেই না সারলে ছাতিমের আঠা শুকিয়ে গুঁড়া করে ক্ষতের উপর ছিটিয়ে দিলে সেরে যাবে।
৮) দাঁতের যন্ত্রণায় আক্রান্ত দাতে ছাতিমের আঠা দিতে হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থ ভাগবতে এ কথা উল্লেখ আছে।
৯) মাঝে মাঝে জ্বর হয়, মুখে অরুচি, দাঁত পরিস্কার হয় না, আস্তে আস্তে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। এরূপ ক্ষেত্রে ১০/১২ গ্রাম ছাতিম ছাল চার ভাগের তিন কাপ পানিতে সেদ্ধ করে (শুকনা ছাল ৫/৬ গ্রাম) ঘেঁকে নিয়ে ঐ পানি সমান ভাগে সকালে বিকালে খেলে ২/১ দিনের মধ্যেই জ্বর সেরে যায়।
১০) বাকলের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সারের ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর রস আঠা ও মূল টিউমার এমনকি ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগেও ব্যবহৃত হয়।
১১) ছাতিম গাছের ছাল সেদ্ধ করে যে নির্যাস তৈরী করা হয়, ম্যালেরিয়া রোগের জন্য তা খুবই ভাল ঔষুধ। ম্যানিলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ছাতিম গাছের ছালের নির্যাস ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। তাদের ধারণ, এটা কুইনাইনের বদলেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ইন্ডিয়ান ইন্ডিজেনাস কমিটিও এ নির্যাস দিয়ে ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা করেন এবং সাফল্য পেয়ে থাকেন।
রাসায়নিক উপাদান : এচিটামিন (Echitamine) এচিটামিডিন (Echitamidine), লেকটনস (Lactones) ও স্টেরল (Sterols) ইত্যাদি।
ব্যবহার : কাঠ নরম, হালকা ও ভঙ্গুর। কাঠ বাক্স, হালকা ও সস্তা আসবাবপত্র, কারুকাজ, ক্ষুদাই, কফিন, ব্ল্যাকবোর্ড, স্কাববোর্ড, চায়ের বাক্স, প্লাইউড, ম্যাচউড হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাকল পুরানো ডাইরিয়া, ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, কাঠ ছোরা/তরবারীর খাপ ও শবশকট নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়।