কালো তুলসী গাছ
প্রচলিত নাম : কৃষ্ণ তুলসী, কালো তুলসী
ইংরেজী নাম : Common Basil
বৈজ্ঞানিক নাম : Ocimum sanctum, Linn
পরিবার : Lamiaceae (Labiatae)
পরিচিতি : তুলসী গুল্ম জাতীয় সুগন্ধি যুক্ত উদ্ভিদ। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট এটি অত্যন্ত পবিত্র উদ্ভিদ। সাধারণতঃ ৬০-৯০ সে. মি. উঁচু হয়ে থাকে। এর কাণ্ড সরল, শাখা-প্রশাখা বিপরীত বিন্যস্ত। শাখার প্রান্তদেশ অমসৃণ, পাতাও চারিদিক করাতের মত খাঁজকাটা থাকে। শরৎ ও হেমন্তকালে ফুল হয়। পাতা চর্বন করলে সুগন্ধযুক্ত পানের মত স্বাদ পাওয়া যায়। বীজ চ্যাপ্টা, মসৃণ ফিকে লাল বর্ণের । বিভিন্ন গ্রন্থে তুলসীর অনেক প্রকারের কথা উল্লেখ থাকলেও আমাদের দেশে চার ধরনের তুলসীর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন: বাবুই তুলসী (O. basilcum), রামতুলসী (0. gratissinuum), কৃষ্ণ তুলসী (O. sanctum) ও সাদা তুলসী (O.albuin)। সাধারণতঃ একটির পরিবর্তে অন্যটি ব্যবহার করা যায়। এতে গুণাগুণের তেমন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।
ব্যবহার্য অংশ : বীজ, পাতা ও রস।
বিস্তৃতি : বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে তুলসী দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাড়ীতে এটি পাওয়া যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিছু এলাকায় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে তুলসীর চাষ হয় বলে জানা যায়।
বীজ সংগ্রহ : জুলাই-আগস্ট অথবা নভেম্বর-ডিসেম্বর।
বীজের ওজন : প্রতি কেজিতে প্রায় ৩.০ মিলিয়ন।
বীজ আহরণ ও বংশ বিস্তার : সবুজ বৃতি বিশিষ্ট ছোট সাদা ও হালকা বেগুনী ফুল ফোটে। পাকা বীজ ধূসর বর্ণের হয়। সাধারণতঃ বীজ থেকেই তুলসীর নতুন চারা গজায় এবং গাছের থেকে বীজ মাটিতে পরে প্রাকৃতিকভাবেই নতুন চারা গজায়। আমাদের দেশে কিছু কিছু নার্সারিতে চারা পাওয়া যায়। তুলসীর বীজ অঙ্কুরোদগম হার শতকরা ৫০-৬০ ভাগ।
চাষাবাদ
বীজ বপন ও চারা রোপণ পদ্ধতি : সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের দিকে বীজ বপন করা হয়। পরিপক্ক বা পাকা বীজ সংগ্রহের পর তা রৌদ্রে শুকাতে হবে এবং বপনের পূর্বে ৫-৬ ঘন্টা ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সাধারণতঃ ৫-৬ ফুট অন্তর চারা লাগাতে হবে। যে কোন বড় গাছের সাথে কিংবা রাস্তার পাশে তুলসীর চাষ এবং গাছ লাগানো যায়। আংশিক ছায়াতেও এ গাছ ভাল জন্মে।
উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি : খোলামেলা জায়গায় তুলসী গাছ বেশী হতে দেখা যায়, যেমন: ঘরের আঙ্গিনা, রাস্তার আশেপাশে, সমতল ভূমির আর্দ্র ও গরম এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়। সব ধরনের মাটি তুলসী গাছের জন্য উপযোগী, তবে বেলে দোঁআশ মাটিতে অধিক পরিমাণে তুলসী গাছ জন্মে। তাছাড়া তুলসী টবেও লাগানো যায়।
সংগ্রহ ও সংরক্ষন পদ্ধতি : তুলসী পাতা কাঁচা ব্যবহারই উত্তম। তুলসী গাছ পাতাসমেত উত্তোলনপূর্বক ভালভাবে ধুয়ে ছোট ছোট করে কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে নিয়ে শুষ্কস্থানে সংরক্ষণ করতে হবে এবং এক বছর ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে পাতা বাদামী রং ধারন করা পর্যন্ত শুকিয়ে নিতে হয়। রৌদ্রে শুকাবার সময় কোন রকম ধুলাবালি যেন না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে প্রয়োজন মত পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে ড্রাই চেম্বার ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকাবার পর পাতার আর্দ্রতা যেন শতকরা ২ ভাগ থাকে। প্যাকেটের গায়ে সংগ্রহের তারিখ, উৎসস্থল, সমাক্তিকর এবং ব্যবহারের শেষ সময় অবশ্যই উল্লেখ রাখতে হবে।
ঔষধি গুণাগুণ : কাশি, খুসখুসে কাশি, শ্বাসকষ্ট, শিশুদের সর্দিকাশি ও যকৃতের গোলযোগে বিশেষ ফলপ্রদ। তাছাড়া ঘামাচি, চুলকানি, কর্ণবেদনা, বসন্ত, দাদ ও কৃমিতে কার্যকরী।
ঔষধি ব্যবহার
১) কাশি ও হাঁপানিতে : প্রতিবারে তুলসী পাতার রস ৩(তিন) চা চামচ এবং আদার রস ১(এক) চা চামচ মধুসহ প্রত্যহ ২-৩ বার সেবন করে গেলে আশাতীত উপকার হয়।
২) হাম ও বসন্তে : তুলসী পাতার রস ২-৩ চা চামচ সেবন করে গেলে দ্রুত হাম ও বসন্তের গুটি বেরিয়ে আসে। নিয়মিত ৪-৫ দিন সেবন করে যেতে হবে।
৩) কর্ণ বেদনায় : তুলসী পাতার রস ৩-৪ ফোটা ঈষৎ গরম করে দিনে ২/৩ বার কানে প্রয়োগ করলে কর্ণবেদনা সেরে যায়।
৪) কৃমি রোগে : তুলসী পাতার রস ২ (দুই) চা চামচ, লেবুর রস ১ (এক) চা-চামচ মিশিয়ে প্রত্যহ ২/৩ বার সেবন করলে সব ধরনের কৃমিরোগে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ৪-৫ দিন নিয়মিত সেবন করে যেতে হবে ।
৫) ঘামাচি ও চুলকানিতে : তুলসী পাতা ও দুর্বা ঘাসের ডগা সমপরিমাণ নিয়ে ভালোভাবে পিষে প্রয়োজন মতো ঘায়ে মাখলে ঘামাচি ও চুলকানি নিরাময় হয়।
৬) তুলসী পাতার রস পানিতে ভিজিয়ে চিনি মিশিয়ে খেলে প্রস্রাবজনিত সমস্যায় খুব উপকার হয়।
সাধারণ ব্যবহার : হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যে কোন পূজা অর্চনায় তুলসী পাতা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অনেকে তুলসীর কাষ্ঠাল অংশ দিয়ে মালা তৈরী করেও অনেকে গলায় ধারন করে। উল্লেখ্য যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় এ মালা তৈরীর একটি কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে এবং এখান থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে বৎসরে প্রায় ২০/২৫ হাজার টাকার মালা চালান হয়।
রাসায়নিক উপদান : পাতার মধ্যে ইউজেনল, ফিনোল এবং প্রচুর পরিমাণে উদ্বায়ী তেল বিদ্যমান। তাছাড়া কার্বাক্রোল, মিথাইল ইউজেনল এবং কারিওফেলিন, সিনিওল, গ্লাইকোসাইড, সাইট্রিক ও টার্টারিক এসিড পাওয়া যায় ।
বাজার চাহিদা : ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিও ঔষধ শিল্পে বক্ষের বিভিন্ন রোগসমূহ, যেমন: কাশ, শ্বাসকষ্ট, সর্দিজ্বর, বক্ষ প্রদাহ, ব্রঙ্কাইটিস, খুসখুসে কাশিতে তুলসীর কার্যকারিতা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বিধায় প্রচুর ব্যবহার করা হয়। পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব ঔষধ শিল্পে প্রতি বছরে প্রায় ১০০০ টনের মতো তুলসীর প্রয়োজন হয়।
প্রজাতিভিত্তিক ঔষধি ব্যবহার : আমাদের দেশে প্রধানত তিন ধরণের তুলসী পাওয়া যায়। এদের ঔষধি ব্যবহার নিম্নরূপ :
১। কালো তুলসী (Ocimmuuuie sanctum Linn.): এ তুলসী সর্বত্রই পাওয়া যায়। সুরস্য তুলসী বর্ণভেধে শ্বেত ও কৃষ্ণ দু’ধরনের দেখা যায়। তবে গুণের দিক থেকে দুই এক রকমের।
- সুরসা ও বাসক উভয়ের রস একসঙ্গে মিশিয়ে নাকে নিলে নাসারোগ থেকে মুক্তি পায়।
- তুলসী পাতার সঙ্গে শ্বেত, মরিচ, শুঠ গুঁড়ো করে দু’বেলা সেবন করলে, সবিরাম ও অবিরাম দু’রকমের জ্বর থেকেই আরোগ্য লাভ করা যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, ম্যালেরিয়া জ্বরে সুরসা তুলসী এবং অশ্বত্থ বৃক্ষ দুটিই বিশেষ উপকারী।
- লেবুর রসের সঙ্গে সুরসা তুলসী পাতা পিষে দাদগ্রস্ত স্থানে ঘষলে দ্রুত ফললাভ হয়।
- কৃষ্ণ সুরসা তুলসীর রস মধুর সাথে সেবন করলে কফজাত কাশ বিনাশ হয়।
২। শ্বেত/বাবুই তুলসী (Ocimum basilicum Linn.)
- বাবুই তুলসী আমাতিসার, কফ, গণোরিয়া, প্রসূতিদের প্রসবের পরবর্তী বেদনা, জীর্ণ জ্বরের পীতাবস্থায় ও বমি নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- এ তুলসীর রস বিন্দু বিন্দু করে কানের গর্তে দিলে কর্ণশূলে বিশেষ সূফল পাওয়া যায় ।
- বৃক্কের ব্যথা, আম বা রক্তাতিসার, রক্তমূত্র ও কাশরোগে এ বাবরী তুলসীর রস প্রয়োগ হয়ে থাকে।
বাবরী তুলসীর বিচি পানিতে ভিজিয়ে নাড়াচাড়া করলে যে লালবস্তু পাওয়া যায় তাই শুক্রমেহরোগের অব্যর্থ মহৌষধ।
- বাবরী তুলসীর শেকড় পানের সঙ্গে চিবিয়ে খেলে রক্তামাশয় দ্রুত আরোগ্য হয়।
৩। রাম তুলসী (Ocimum grastissimum): গ্রামাঞ্চলে তামাক সুগন্ধি করার জন্য লোকে এ তুলসীর পাতা ও মুঞ্জুরী ব্যবহার করে থাকেন।
ব্যবহার/অন্যান্য :
- বাড়ীর আশেপাশে তুলসী গাছ থাকলে মশার উপদ্রব কম হয় এবং তুলসী গাছের স্পর্শ সংক্রামক ব্যাধিকে দূর করে বলে প্রকাশ।
- যে সমস্ত শিশুর সর্দি, কাশি, পেট কামড়ানি ও লিভার দোষ আছে তাদের প্রত্যহ সকালে ৫/৬ ফোঁটা তুলসী পাতার রস ২/৪ ফোঁটা মধুসহ কিছুদিন খাওয়ালে এসব অসুবিধা দূর হয়। এতে তাদের কোষ্টবদ্ধতাও দূর হয়।
- তাজা তুলসী পাতার রস, মধু, আদা ও পেঁয়াজের রসের সাথে একত্রে সেবন করলে সর্দি ভাল হয় এবং হাঁপানির উপকার হয়।
- তুলসী পাতা ও দুর্বাঘাসের ডগা বেটে গায়ে মাখলে ঘামাচির চুলকানি কমে। পাতা ও শিকড়ের ক্বাথ ম্যালেরিয়া জ্বর নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
- তুলসী পাতার রস গায়ে মাখলে বসন্তের দাগ এমনকি হামের দাগও উঠে যায় এবং দাদ ও চর্ম পীড়ায় উপকার হয়।
- হাম ও বসন্ত বের হতে দেরী হলে তুলসী পাতার রস সেবনে তা দ্রুত বেরিয়ে আসে।
- দূষিত রক্তশোধনে তুলসী রস কিছুদিন নিয়মিত খেলে উপকার পাওয়া যায় ।
- কাসের ব্যথা, ক্রিমি রোগ ও অজীর্ণ জনিত পেট ব্যথা নিরাময়ে তুলসী পাতার রস বেশ উপকারী।